পাঞ্জোরার হারিয়ে যাওয়া গীর্জার খোজ করতে গেলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে আমাদের এই অঞ্চলে ভাওয়াল অঞ্চলে কিভাবে খ্রীষ্টানদের গোড়া পত্তন হয়েছিল ।কি ভাবে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে এত বেশী খ্রীষ্টানদের বসবাস ।
দোম আন্তনীও!!!!!!
কে এই দোম আন্তনীও, আর কেনই বা আমি উনার কথা বলছি,লেখাটা পড়লে আপনিও বুঝতে পারবেন। দোম আন্তনীও, যার জন্ম আনুমানিক ১৬৪৩ সালে। দোম আন্তনীও ছিলেন ভূষনার রাজপুত্র।১৬৪৯ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে আরাকান মগরা বাংলায় লুটতরাজ করার সময়, বহু নারী শিশুদের সাথে তাকেও বন্দী করে। কিন্ত যখন তার বংশ পরিচয় সমন্ধে জানতে পারে তখন মগেরা পর্তুগিজ নাবিকদের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়।দোম আন্তনীর পিতৃ পরিচয় পাওয়া যায় না।তবে অসর্মথিত সুত্র থেকে জানা যায় যে,বাংলার বারো ভুইয়াদের সীতারাম নামের একজন নবাব মুর্শীদকুলির কাছ থেকে কয়েকটি গ্রাম ইজারা নেন,এবং একটি রাজ্য গড়ে তুলেন। ধারনা করা হয়,এই সীতারামের ছেলে এই দোম অন্তনী ডি রোজারিও। আর পর্তুগীজরা দোম আন্তনীও কে আগষ্টিন ফাদার মানুয়েল ডি রোজারিও এর নিকট পুনঃরায় বিক্রি করে দেয়। ফাদার তাকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করতে চাইলে সে তার নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে চায় নি।কথিত আছে যে,স্বপ্নে যীশু খ্রীষ্টের সাক্ষাতের পর অবশেষে উনি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। এবং ফাদার তা নাম রাখেন দোম আন্তনীও ডি রোজারিও।যেহেতু ফাদার এর পদবী ছিল রোজারিও তাই উনি নিজের পদবী ছেলেটিকে দেন।”দোম “একটি পর্তুগিজ শব্দ, যার বাংলা হচ্ছে রাজপুত্র।দোম আন্তনী এই নামটি আমাদের কাছে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অজানাই ছিল। ১৯১৪ সালে একজন জেজুইট ফাদার, ফাদার হোস্টেন যিনি একজন ইতিহাসবিদ এবং গবেষক তিনিই আমাদের কাছে দোম আন্তনীওর পরিচয় করিয়ে দেয়। Bangal Past and Present, নিবন্ধে The Three first type printed Bengali Books, আলোচনা করতে গিয়ে এই নামটার সাথে আমাদের পরিচয় করে দেন।এর পর ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন আবার উনার প্রবন্ধে দোম আন্তনীও নামটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে এই নামটার সাথে সবচেয়ে বেশী পরিচয় করিয়ে দেন, ডক্টর তারাপদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত দোম আন্তনীও সমন্ধে পর্তুগীজ ফাদারদের অনেক চিঠি ও প্রতিবেদন উদ্ধার করেন। এবং তিনিই সর্বপ্রথম দোম আন্তনীও তথ্য নির্ভর জীবনী প্রকাশ করেন। তিনিই বলতে গেলে এই মানুষটাকে বংগে খ্রীষ্টান ইতিহাসের নায়ক হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। দোম আন্তনীও জন্মসাল ১৬৪৩ সালে, ১৬৪৯ সালে উনি অপহৃত হন।এবং ১৬৬৬ সালে তিনি, স্বজাতী এক মেয়েকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। শুধু তাই নয় উনি নিজের কাকীমা,এবং তার অনেক আত্নীয় স্বজনকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। দোম আন্তনীও ধর্মগুরু মাদার ম্যানুয়েল চট্রগ্রাম থেকে গোয়ায় বদলী হলে,দোম আন্তনীও চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন। দোম আন্তনীও মাত্র ২৩ বছর বয়সে খ্রীষ্টধর্মতত্ত্ব ও পর্তুগীজ ভাষায় পান্ডিত্য লাভ করেন। হিন্দু থেকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়া দোম আন্তনীও মাত্র দুই বছরে আমাদের এই ভাওয়াল অঞ্চলের প্রায় ২০ থেকে ত্রিশ হাজার মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন।আর এই ভাবেই আমাদের অঞ্চলে খ্রীষ্ট ধর্মের ।
এবার আসি নাগরী ধর্মপল্লীর জন্মকথাতে!!
সাল টা ছিল ১৬৯৫ সাল।ফাদার লুই দস আজ্ঞস নামের এক পুরোহিত নাগরী গ্রাম টি ক্রয় করেন।তবে জেনে রাখা প্রয়োজন এর অনেক আগে থেকেই নাগরী এবং এর পাশ্ববর্তী এলাকাতে প্রায় ২০ হাজার খ্রীষ্টান বাস করত। আপনারা যদি নাগরী গীর্জায় যান,তাহলে দেখবেন যে,ওখানে লেখা আছে সেন্ট নিকোলাস চার্চ স্থাপিত ১৬৬৩ সাল। অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা নাগরী ধর্মপল্লীর পুরাতন চার্চ টি কখনোই ১৬৬৩ সালে নির্মিত হয় নি। এই চার্চ নির্মিত হয়েছে ১৮৮৮ সালে। তাহলে এই ১৮৮৮ সালের চার্চের গায়ে কেন ১৬৬৩ সাল লেখা? ধারনা করা হয় মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে ফলে, এবং জমিদার কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকার হওয়া খ্রীষ্টানদের ভূষনার কোষাভাঙা থেকে নাগরীতে নিয়ে আসেন দোম আন্তনীও । নাগরীতে পরবর্তীতে উনি আরো পাচটি গ্রাম কিনেন? করান, তিরিয়া,বাগদী এই অঞ্চল গুলো।ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষের সাথে আমাদের ভাওয়াল অঞ্চলের খ্রীষ্টানদের ভাষাগত মিল থাকার একটা কারন হচ্ছে,এই অঞ্চলের অনেক খ্রীষ্টান ফরিদপুরের কোষাভাঙা থেকে আগমন করেছে।আর এই ভাবে নাগরীতে খ্রীষ্টান বসতি স্থাপিত হয়।
আসলে নাগরী তে, যে জায়গায় চার্চ টি আছে সেটা সেখানে নাও থাকতে পারত।এই চার্চটি থাকতে পারত পাশ্ববর্তী গ্রাম পাঞ্জোরাতে। ১৭১৪ সালে ফাদার বার্বিয়ে নামে একজন পুরোহিত এখানে একটা চার্চের কথা করেছিল।তিনি বলেছিলেন, ভাওয়াল অঞ্চলে আসার পর তিনি একটা চার্চ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। নাগরী মূলত, পর্তুগীজ ফাদারদের জায়গীর কিংবা জমিদারীর আন্ডারে ছিল।আমি যখন নাগরীর ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা করছিলাম তখন আশ্চর্য হলাম যে, নাগরীর এই জায়গীর এর পরিমান ছিল ২৫০০০ একর। আরো আশ্চর্য হলাম নরসিংদী জেলার রায়পুরা,নোয়াপাড়ার মত এলাকার মত জায়গাও এই নাগরীর জমিদারির অংশ ছিল।দক্ষিন ভারত থেকে এই জমিদারী দেখা শুনা করা হতো। দক্ষিন ভারতের মাইলাপুরের বিশপ যিনি হতেন তিনিই ছিলেন এর মালিক। তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো,এই জমিদারের সব জমি কিন্তু ক্রয় কৃত ছিল না।এর বিশাল একটি অংশ দান করা ছিল।আর যিনি দান করেছিলেন, উনার নাম হচ্ছে,ক্যাথরিনা পিরিচ। উনি পাঞ্জোরা, পাড়ারটেক,রাতুন,কেটুন,করান, লুদুরিয়া,উলুখোলা,করান,পাওরান,মঠবাড়ি,সহ অনেক জায়গা দান করেছিলেন। উনার সমন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না।তবে উনি জমিদার কন্যা ছিলেন এবং খ্রীষ্ট বিশ্বাসী ছিলেন প্রচন্ড ভাবে।এই জমি গুলোতে ফলন ভালো হতো এবং অপেক্ষা কৃত দামী ছিল। বসত বাড়ি করার জন্য উপযুক্ত ছিল।ভদ্র মহিলা খুব সম্ভবত ১৮১৫ সালের এর আশে পাশে জীবিত ছিলেন। উনার কবর এখনো পাঞ্জরাতে দেখতে পাওয়া যায়। ১৭৭০ সালের দিকে পাঞ্জোরাতে একটি চ্যাপেল নির্মান করা হয় বলে ধারনা করা হয়।ভদ্রমহিলা ফাদারদের এই অঞ্চলের জমিদারিত্ব দান করেন।
১৬৮০ সালের কিংবা আশে পাশের দিকে, ফাদার আজ্ঞস, রুপবাবু নামের এক লোকের কাজ থেকে কিছু জমি ইজারা নেন। এর জন্য রুপ বাবুকে বছরে একটি অংশ রুপবাবুকে দিতে হতো। কারন রুপবাবু ছিলেন,ছাইতান,ভুরুলিয়া,বাগদী,তিরিয়া এই গ্রাম গুলোর মালিক।রুপ বাবুকে কিছু পরিমান টাকা দিয়ে এই জমিদারিত্ব চালাতে হতো।
এবার আসা যাক লেখার মূল আলোচনায় ।
পাঞ্জোরাতে ১৭৭০ সালের দিকে চার্চ প্রতিষ্ঠার তথ্য পাওয়া যায়। আর এই চার্চ টি ধারনা করা হয় সাধু আন্তনীর চার্চ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান সময়ে আমাদের এই অঞ্চলে সাধু আন্তনীর গান ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ।ধারনা করা হয় ,এই গান গুলো লেখার উৎসাহ এসেছে এই সাধু আন্তনীর ১৭৮৯ সালে আগষ্টিয়ান প্রভিন্সিয়াল, এই চার্চের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা ভালো যে,ওই সময় নাগরী এবং পাঞ্জোরা দুইটি আলাদা আলাদা চার্চ ছিল।সেন্ট নিকোলাস চার্চ আর সেন্ট আন্তনী চার্চ।এই দুই চার্চের আন্ডারে ছিল কয়েক টি এলাকা।নাগরীর অধীনে ছিল রুপ বাবুর অধিকৃত জমি মানে করান,বাগদি,তিরিয়া,ছাইতান আর এর বাইরে তুমিলিয়া রাঙ্গামাটি ছিল পাঞ্জোরার অধীনে।কিন্ত মদ খাওয়ার জেরে ১৮৩৫ সালে তুমিলিয়া আর রাঙামাটির খ্রীষ্ট ভক্তরা বিদ্রোহ করলে ১৮৩৬ সালে তুমিলিয়া ভাগ হয়ে যায়। এই লেখার নিচে, লিংক দেওয়া আছে,কিভাবে তুমিলিয়া ভাগ হয়। আর যখন তুমিলিয়া ভাগ হয়, তখন পাঞ্জোরার অধীনে কোন খ্রীষ্ট ভক্তই অবশিষ্ট রইলো না। এই অবস্থা বজায় থাকল ১৮৪১ সাল পর্যন্ত। সাধু আন্তনীর চার্চ, পাঞ্জোরার সর্ব শেষ ফাদারের নাম ছিল ফাদার গাব্রীয়েল সালভাদর ব্রিটো।আর যখন খ্রীষ্ট ভক্ত পাঞ্জোরাতে আসলো না, তখন আস্তে আস্তে সাধু আন্তনীর চার্চ টি ধবংশ স্তুপে পরিনত হলো।তবে সাধু আন্তনীর চার্চ বন্ধ হলেও সাধু আন্তনীর মহিমা বন্ধ হয় নি।সাধু আন্তনী বার বার পাঞ্জোরাতেই ফিরতে চেয়েছিলেন। এই নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে বিধায় আমি আর সেই কথা উল্লেখ্য করলাম না।
১৯০৩ সাল। সাধু আন্তনীর অলৌকিক কাহিনী এত টাই প্রচলিত ছিল যে,ওই সালের ৯ ই ফেব্রুয়ারী তে মাইলাপুরের বিশপ থিউটিনিয়াস ডি কস্তা সাধু আন্তনীর নামে একটা আবার চ্যাপেল স্থাপন করলেন। আর ১৯০৮ সালের ১১ ই মে সেই চ্যাপেলে প্রথম খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করা হয়। আর ১৯৩০ সালে ৫ ই মে নাগরী এবং পাঞ্জোরাকে ঢাকা ধর্মপ্রদেশের নিকট হস্তান্তর করা হয়।। আর নাগরী হয়ে যায় বাংলাদেশের ভ্যাটিকান ।
নাগরীকে ভ্যাটিকান বলার কারন হচ্ছে,রোমান ক্যাথলিক চার্চ মূলত ভ্যাটিকান সিটি থেকে পরিচালনা করা হয়।ঠিক তেমনি এই ভাওয়াল অঞ্চলের চার্চ গুলো ও একসময় নাগরী কেন্দ্রিক ছিল।নাগরী থেকেই চার্চ গুলো পরিচালনা করা হত। বাংলা সাহিত্যের অনেক ইতিহাস এখানে বসেই রচিত হয়েছে।দোম আন্তনীও এর ব্রাহ্মণ – রোমান ক্যাথলিক সংবাদ নামের গ্রন্থ এখান থেকেই লেখা হয়, এই নাগরীতে বসে।বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থের একটি হলো কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ এই নাগরীতে বসেই রচনা করেন ফাদার ম্যানুয়েল দা আসুম্পাসাও, ১৭৩৫ সালে। যা এখনো পর্তুগালের লিজবনে সংরক্ষিত আছে।এই নাগরীকে কেন্দ্র করে,ডাল পালা গজিয়ে কালীগঞ্জে বিশাল অঞ্চল জুড়ে খ্রীষ্টান বসতি।
সহায়ক গ্রন্থ এবং কৃতজ্ঞতাঃ
১।বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সমাজ-লুইস প্রভাত সরকার।
২।বংলাদেশের খ্রীষ্ট মন্ডলীর পরিচিতি -ফাদার দিলীপ এস কস্তা।
৩।বাংলাদেশের খ্রীষ্ট ধর্ম ও খ্রীষ্ট মন্ডলীর ইতিকথা- ফাদার আলবার্ট টমাস রোজারিও।
৪.ইতিহাসে উপেক্ষিত -তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
৫।বাংলাদেশের খ্রীষ্টমন্ডলী- জেরম ডি কস্তা।
৬।জানার আছে অনেক কিছু – ইফফাত আরা
সহ কারো অনেকে।