সমুদ্র বিলাশ

                                                             

প্রকৃতি কিছু কিছু রহস্য নিজের কাছেই রাখতে পছন্দ করে,মানুষ কে জানতে দিতে চায় না ।প্রকৃতি ,মাঝে মাঝে আমাদের সাথে রহস্য করতে ভালবাসে ।আমি এক কাট খোট্টা টাইপের মানুষ ,এই রহস্য টহস্যের ধার ধারি না।যুক্তির মাধ্যমে চিন্তা করার চেষ্টা করি ।কিন্ত প্রকৃতি সেই যুক্তিবাদী চিন্তা ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে ।সাগর আর পাহাড়ের অতি কাছে ,চাকুরির সুবাধে বসবাস করতে হচ্ছে।মাঝে মাঝে হেটে হেটে বিশাল সমুদ্রের কাছে গিয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়,নিজেকে বিশাল ভাবতে মন চায় ।কিন্ত কেন জানি সমুদ্রের মত বিশাল হতে পারে  নি।যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি ,ওই প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু অদ্ভুদ লোকের সাথে আমার পরিচয় ।পৃথিবীতে এমন সমস্ত লোক জন থাকতে পারে আমার ধারনা ছিল না ।তেমন এক জন হচ্ছে ,মৃন্ময় দা।বেচারা দেখতে শুনতে ,কথা বার্তায় সব দিক দিয়ে ভাল ।তবে কেমন জানি রহস্য করে কথা বলে ।যতটুকু জানি ভদ্রলোক আগে কোন একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ।কোন একটা অজানা কারনে সেই চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন ।সবাই যখন পরিবার নিয়ে কথা বলে ,ভদ্রলোক সেই আলোচনায় কেন জানি থাকে না ।উঠে যান ।কেউ বিষয় টা লক্ষ্য না করলেও এই বিষয়টা আমি অনেক বার লক্ষ্য করেছি ।একে তো বয়োজেষ্ঠ মানুষ ।তার উপর আবার ডিপার্ট্মেন্টের বস।আধাপাকা চুল ,গায়ের চামড়াতে ভাজ পরা শুরু করেছে ।তবে ভদ্রলোক চশমা পরেন না ।আমি যতগুলা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি ,সব গুলো প্রতিষ্ঠানের আমার যারা সিনিয়র ছিল সবাই দেখতাম চশমা পরত ।এই ভদ্র লোক পরেন  না ।আজ যখন লিখতে বসেছি ,তখন আমার জীবনের এই রহস্যময় ঘটনা ঘটে গেছে ।কেমন জানি ,ভাবতে গেলেও অদ্ভুদ এক অনুভুতি কাজ করছে ।দুই দিন আগের কাহিনী ।অফিস শেষ করে ,জুনিয়র কলিগ বৃন্দ যখন সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন ,মজ মাস্তি করার জন্য সমুদ্রের পাড়ে যাবার প্ল্যান করছি ,তখন কোথা থেকে এসে মৃন্ময় দা এসে বলল ,সেও আমাদের সাথে সমুদ্রের পারে যাবে ।বাচ্চাদের সাথে যখন ,মুরব্বীরা কোন পার্টি তে যোগ দেয় তখন সেটা পার্টি থাকে না সেটা হয়ে যায় শিক্ষা সেমিনার ।এটা করতে পারবে না ,ওটা করতে পারবে না ।ওই মেয়ের দিকে তাকানো যাবে না ।সুন্দরি মেয়েদের কাছে যাওয়া যাবে না ।অনেক ঝামেলা ।আমরা কলিগরা একে অপরের মুখে তাকালাম ।কেমন জানি বির্বন হয়ে গেলে ,মুখ গুলো ।বেচারাদের জন্য আমার ও খুব খারাপ লাগছিলো ,না পারছে প্রোগাম বাতিল করতে ,না পারছে মৃন্ময় দা কে না করতে ।কারন পার্টির ৭০% টাকা উনি দিবেন বলে দিয়েছেন ।এই অফার কারো পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না ।আর পার্টি তে গিয়ে উনার শিক্ষা সেমিনারের প্যারা কেউ নিতে ও পারবে বলে মনে হচ্ছে না ।যাই হোক ,প্যারা যতই হোক না কেন সবাই টাকার কাছে হেরে গেছে ।মৃন্ময় দা কে নিয়েই পার্টি করতে রাজী হয়েছে ।

বৃহস্পতিবার ,যথারীতি অফিস টাইম শেষ করে ,আমরা সবাই ইনানী পয়েন্টের কাছে বিখ্যাত হোটেল ,হোতেল রয়েল টিউলিপে উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ।সবাই কেমন জানি ,মন মরা মন মরা হয়ে রয়েছে।সারা সপ্তাহ কাজ করার পর যখন সিরিয়াস বসের সাথে পার্টি তে যেতে হয় ,তখন কার ভালো লাগে ।আমরা তিন জন ,আর সাথে আমাদের খারুস বস ।না পারি কইতে ,না পারি সাইতে।রয়েল টিউলিপ আমাদের পরিচিত জায়গা ।এখানকার সব গুলো ওয়েটার আমাদের চিনে।আর চিনবে না কেন ,প্রতিবার যে পরিমান টিপস দিয়ে যাই ,তা মনে হয় বেতনের চার ভাগের ভাগ ।যাই হোক ,প্রথমে একটু সফট দিয়েই শুরু করলাম ।ওয়েটার কে বললাম ,চার টা ব্লাক ডেভিল দিতে ।আমরা তিন জন ব্ল্যাক ডেভিল নিয়ে অসহায়ের মত ,বসের মুখের দিকে তাকালাম।এই দৃষ্টির নাম ,অনুমুতির দৃষ্টি ।মৃন্ময় দা ,তার ক্যান টা খুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ,লজ্জা পেয়ো না ,শুরু কর ।আজকে আমি তোমাদের বস না ,বন্ধু ।।

অবশেষে ,আমরাও একটু রিলেক্স হলাম ,যে যার যার ক্যান খুলে চিয়ার্স করলাম ।সাধারনত ,বৃহস্পতিবার এই হোটেলের বারে অনেক মানুষ থাকে ,তবে কোন এক অজানা কারনে আজ বেশি মানুষ নেই ।আমরা চার জন  ,আর হাতে গুনা তিন জন ।আর ,যে তিন জন আছে ,তারাও এখান কার স্থানীয় না ।ঢাকা থেকে এসেছে ।আর আমরা এখানে থাকতে থাকতে স্থানীয় হয়ে গেছি ,ভাষা টাষা সব ই আমরা পারি ,আর আমাদের কেমন জানি একটা এক্সট্রা ক্ষমতার দম্ভ আছে ।কারন আমাদের বস এখানকার স্থানীয় এবং খুব প্রভাবশালী ।কেউ কিছু বললে ,গায়ে হাত তুলে ফেলব সেটা আমরা তিন জনই শিওর ।যা করার বস পরে করবে ।বার গুলোতে সব সময় ই একটু খোলামেলা হিন্দি গান চলে ,সেটা আমরা সবাই জানি ।দুই এক প্যাক মারার পরে ,বার বার আমাদের সেই ভিডিও এর দিকে চোখ যাচ্ছিল ।তিন জন অবিবাহিত পুরুষ ।কামুকতা জাগাটাই স্বাভাবিক ।কিন্ত মৃন্ময়দার  সেই দিকে কোন খেয়াল নেই ।নিজের মনে ব্ল্যাক ডেভিলে চুমুক দিচ্ছেন তিনি ।তারপর ,হঠাৎ ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে ,একটু উচু স্বরে ওয়েটার কে ডাকদিলেন ,’’ইক্কে আয়’’মানে এদিকে আয় ।যাই হোক ,যেহেতু লোকাল ল্যাংগুয়েজ সবাই বুঝবে না ,তাই বাংলায় ই বলছি ।উনি ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে বললেন,একটা ব্ল্যাক লেভেল নিয়ে আসতে আর এই সমস্ত গান বন্ধ করে ডিস্কোভারি চ্যানেল দিতে ।প্রথম টাতে আমরা সবাই খুশি ,কারন আমাদের মত গরীবদের কেরু এন্ড কোং ছাড়া অন্য কিছু খাবার সামর্থ ছিল না ।আর দ্বিতীয় ব্যাপারটাতে আমরা খুবই হতাশ,কারন বারে এসে যে কেউ ডিস্কোভারী চ্যানেল দেখতে চায় ,সেটা আমরা কেউ জানতাম না ।যাই হোক ,ক্যানে যত টুকু ব্ল্যাক ডেভিল ছিল এক চুমুকে শেষ করে  ,অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই অমৃতর জন্য ।

বৃষ্টিতে ভেজা মাতাল জোৎস্ন্যায়

                                         

ব্ল্যাক লেভেলের ,বোতল দেখার পর ,আমাদের তিন জনের আনন্দ আর ধরে না ।কিন্তু বসের পারমিশন ছাড়া কেউ বোতলে হাত দিতে পারছেনা।আবার সেই পারমিশন মার্কা চেহারা করে বসের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম ।এই বার আর বরফ গললো না ।মৃন্ময় দা ,বলল, ব্ল্যাক লেভেলের হাত দেবার আগে তোমাদের একটা গল্প বলতে চাই ।শুনতে হবে তোমাদের ।আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম,ভাব টা  এই রকম ,এই লে ,শুরু হয়ে গেল শিক্ষা সেমিনার ।ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান ।যাই হোক ,মুখে তো আর  এই গুলো বলা যায় না ।যাই হোক আমি একটু ,আমি একটু নিচু গলায় বললাম ,শুরু করেন দাদা।আপনার কথা আমার অনেক ভালো লাগে ,আগে গল্প পরে দারু ।আমার কলিগদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ,ওরা মুরগির গ্রিল না খেয়ে আমাকে গ্রিল করে খেয়ে ফেলবে  যে কোন সময় ।আমি ওদের অগ্নি দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ,বললাম,দাদা শুরু করেন ।

মৃন্ময় দা ,উনার হাতে থাকা ব্ল্যাক ডেভিলের ক্যানে  ,চুমুক দিয়ে বলল ,এক দেশে এক রাখাল বাস করত ।(আমরা আবার সবার দিকে তাকালাম ,এই লে,রাখাল আর বাঘের গল্প আবার শুনতে হবে ) ।উনি বলতে লাগলেন ,রখালের অনেক গুলো মেষ ছিল ।কিন্তু রাখাল সব মেষ গুলো থেকে একটি মেষ কে সবচেয়ে বেশী পছন্দ করত ।প্রতিদিন ,সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতো ,গোছল করাতো ।( একটা দ্বীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন ) কিন্ত সেই মেষ টা প্রতি দিন কেন জানি দল ছেড়ে চলে যেত ।একা একা ঘুরে বেড়াত।আর রাখাল সারাদিন সেই মেষটাকে খুজে বেড়াত।কিন্ত মেষ টাকে যখন ,রাখাল পেত ,মেষ টা কেমন কেমন জানি রাখাল কে চিনত না ।অচেনা মনে করত ।রাখাল মেষ টাকে আবার তার সাথে এনে খাবার দিত ,যত্ন করত ।এই ঘটনা প্রায় ই ঘটত ।মেষ হারিয়ে যেত ,রাখাল খুজে বেড়াত ,মেষ রাখাল কে চিনত ন।এত ভালবাসার পরে ও কেন যে মেষ রাখালকে মনে রাখতে পারত না ,রাখাল সেটা বুঝতে পারত না ।মৃন্ময় দা বললেন ,আমার গল্প শেষ ,তোমরা ব্ল্যাক লেভেল খুলতে পার ।আমার এক কলিগ ,এই কথা বলার সাথে সাথে বোতল টা খুলে ফেলল ।প্যাক বানাতে শুরু করল ।কিন্ত আমি লক্ষ্য করলাম ,মৃন্ময় দার চোখ কেমন জানি ভেজা ।চোখ ছল ছল করছে ।আমি অন্যদের ইশারা করলাম ,চোখের ইশারায় বুঝালাম ,চুপ থাকতে  । উনি আরেক টা চুমুক দিয়ে বলল,তোমরা কি জান আজ পূর্নিমা ?আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম ।আসলেই তো আজ যে পূর্নিমা আমরা কেউ জানি না ।আর জানব কিভাবে ,সারাদিন যে পরিমান কাজের প্রেসার থাকে তাতে পুর্নিমা আমাব্যসার হিসাব কে রাখে ।উনি আবার বলতে শুরু করলেন ,সবাই এই পুর্নিমা আমাব্যসার হিসাব রাখে না ,কিন্ত আমাকে রাখতে হয় ।কারন মাসে একটা দিন আমি তাকে কাছে পাই ।

আমরা অবাক হয়ে গেলাম ।যতটুকু জানি মৃন্ময় দা বিয়ে করে নি ।পরিবার বলতে কেউ আছে বলে জানি না ।তাকে কাছে পাবার ব্যাপারটা কেমন জানি কৌতুহলের জন্ম দিল ।আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললাম ,কে দাদা।কাকে কাছে পান ।মৃন্ময় দা ,পকেট থেকে একটা বেনসনের প্যাকেট বের করল ।বেনসন সুইস ।দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে বলল,আমার বৃষ্টিতে ভেজা মাতাল জোৎস্ন্যায় আসা এক মায়ারী তরুনীর ।আমরা আসলে কিছুটা অবাক আর একটু বিরক্ত হচ্ছিলাম ।বেনসনের প্যাকেট টা টেবিলের উপর ছিল,যদিও সিগারেট খাই না ,তারপর ও মিস্টিরিয়াস কিছুর শুনার আশায় ,আবেগের বশবর্তী হয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম ।আমার অন্য দুই কলিগ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ।ওরা ভাবতেও পারছেনা আমি বসের সামনে সিগারেট ধরাবো ।তবে এই বিষয় টা আমার অবাক লাগল ,ওরা ও আমার দেখাদেখি সিগারেট ধরাল ।মৃন্ময় দা ,বলল,আমার সাথে ওর দেখা সেই কলেজ লাইফে ।আরাম্ বাগের সেই বিখ্যাত গলিতে ।কক্সবাজার থেকে উঠে আসা এক তরুন ঢাকা শহরে নতুন ।কিছু জানে না ,চিনে না ,সে কিনা এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে গেলে ।একদিন সকাল বেলা ,কলেজের উদ্দেশ্যে যখন রওনা দিচ্ছি সেদিন এই সেই মায়াবী তরুনীর সাথে দেখা হয় ।সে দিন ছিল কলেজের শেষ দিন ।দুই বছরের কলেজ জীবনে কখনো কলেজ মিস না করা ছেলেটা জীবনের শেষ কলেজ ক্লাস টা ওই দিন ই মিস করল ।

আমি এই বার একটু নড়ে চড়ে বসলাম ।এমন অদ্ভুদ মানূষের লাভ স্টোরী অদ্ভুদ হবে সেটা আমি আগেই জানি ।আর যেহেতু লেখালেখি করার বদ অভ্যাস আছে ,তাই অন্য দিকে খেয়াল না করে গল্পে ফোকাস করলাম ।মৃন্ময় দা ,নিজ হাতে ব্ল্যাক লেভেলের বোতল টা নিয়ে নিজের গ্লাসে ঢেলে এক চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগলেন ,বাসা থেকে এত সকাল বেলা বের হয়েছিলাম যে কোন কিছুই পাচ্ছিলাম, না ।তার উপর আবার শীতের সকাল।এত সকালে রিক্সা ওলারা ও বের হতে চায় না ।রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম ,এমন সময় এক রিক্সা আমার কাছে এসে থামল ।সারা রাস্তায় ,আমি ওই রিক্সাওলা আর সেই মেয়েটি ।রিক্সাওলা অনেক টা বিরক্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল ,ভাইজান কয়টা বাজে? আমি বললাম, ৭.০০টা ।রিক্সাওলা পিছনের সিটে বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,আপা এক ঘন্টা হয়ে গেছে কোথায় যাবেন ,কন?আমি লক্ষ্য করলাম ,মেয়েটা কেমন জানি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে ।কিছু বলতে পারছে না ।যা জানার রিক্সাওলা যা বলল,তা হলো মেয়েটা প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ,রিক্সায় ।কিন্তু কোথায় যাবে কিছুই বলতে পারছে না ।আমি লক্ষ্য করলাম ,১৬ -১৭ বছরের একটা মেয়ে ।পোশাক আশাক দেখে মনে হচ্ছে ,মেয়েটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের।আমি বললাম ,আপু আপনি কোথায় যাবেন? মেয়েটি ফুপিয়ে ফুপিয়ে বল,আমি জানি না ।এবার রিক্সাওলা রেগে গেল ,বলল,এই আপা আপনি নামেন তো ,সকাল সকাল আর প্যাচ ভাল লাগছে না ।লক্ষ্য করলাম ,মেয়েটি সুবোধ বালিকার মত নেমে গেল ।আর রিক্সাওলা ,রাগে গজ গজ করতে করতে চলে যাচ্ছে ।আমি মেয়েটার দিকে তাকাই ।গোলগাল চেহারার মেয়েটার ভিতর এক অদ্ভুদ মায়া আছে ,যা কিনা যে কন পুরুষ কে একবার হলেও ,কাছে টানতে বাধ্য করবে ।আমি মেয়েটার দিকে ,তাকিয়ে বললাম, আপনি কোথায় যাবেন ? মেয়েটা তার ছল ছল চোখে বল,জানি না ।আমি বললাম ,আপনি কি ঢাকাতে নতুন ? মেয়েটা ,মাথা নাড়াল ।আমি আবার বললাম,কার কাছে এসেছেন ঢাকায় ? মেয়েটা বলল,জানি না আমার কিছু মনে নেই ।

আমি পরলাম এক মহাবিপদে ।একবার চিন্তা করলাম ,এই মেয়েকে রেখে চলে যাই ,ছিনতাই কারি দলের সদস্য হতে পারে ।কিছুক্ষন পর হয়ত সাংগ পাংগ নিয়ে আমাকে ছিনতাই করতে পারে ।সুন্দরী মেয়েদের বিশ্বাস করতে নেই ।আবার ভাবলাম ,এই মেয়ে এমন না ও হতে পারে,অত্যন্ত পক্ষে মেয়েটার চোখের জল কিন্ত তা বলছে না ।আমি বললাম ,কোথায় যাবেন এখন ?মেয়েটা বল,জানি না ।কোথায় যাব ,কার কাছে যাব কিছুই মনে নেই আমার ।আমি পরে গেলাম মহা ফ্যাসাদে ।কেন জানি মেয়েটার প্রতি কেমন জানি এক অদ্ভুদ টান অনুভব করলাম ।বললাম ,আমার সাথে হাটবেন ?আজ মার কলেজের শেষ দিন ।কোন দিন কলেজ বাধা করেনি ,আজ করব ।আমি ভেবেছিলাম ,মেয়েটা হয়ত ,অচেনা অজানা কন ছেলের সাথে হাটতে চাইবে না ,কিন্ত মেয়েটা বলল,আমি হাটতে অনেক পছন্দ করি ।,সারাদিন হাটতে মন চায় ।আমি বললাম ,চলেন রমনা পার্ক যাই ।মেয়েটা মাথা নাড়াল ।তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানি জানি আমি ওই দিন ই প্রথম কোন মেয়ের সাথে একসাথে হেটেছি এবং সেটা শেষ বারে মতন ।আর কোন দিন অন্য কোন মেয়ের সাথে পাশাপাশি হাটেনি ।মেয়েটা হাটতে হাটতে বল,আপনার নাম মৃন্ময় গোস্বামী ,তাই না ?আমি থমকে দাড়ালাম ,কারন আমি মেয়েটাকে একবার ও বলেনি যে আমার নাম মৃন্ময় ।আমি বললাম ,আপনি জানেন কিভাবে ? মেয়েটা বলল ,আমার না ইন ট্যুশন ক্ষমতা অনেক বেশী,মাঝে মাঝে সব মিলে যায় ।আমি বললাম ,আর কি জানেন ,আমার সমন্ধে ?মেয়েটা বলল,আপনি একটা বিশাল বড় ট্রেজেডির সামনে আছেন।আপনার জীবন চেঞ্চ হয়ে যেতে পারে ,সেই ট্রেজেডির কারনে ।আমি এই আবার থমকে দাড়ালাম ,বললাম ,মানে কি এই কথার ?মেয়েটা কিছু টা নিচু স্বরে বলল,আপনি কোন এক মায়ার বাধা পরবেন ,সেই মায়া থেকে বের হতে পারবেন না।আমি হাসলাম ,বললাম ,আমি প্রচন্ড যুক্তিবাদী একটা ছেলে ,এই সমস্ত ভনিতা আমার কাছে কিছু না ।আপনি মনে করবেন না আমি আপনার কথায় ভড়কে গেছি।

মেয়েটা হাসছে ,বলল।মৃন্ময় সাহেব ,আপনি অযথা রাগ হচ্ছেন ।আমি খুব সাধারন একটা মেয়ে কোন ছিনতাই কারি নই,আর আমার কোন সাংগ পাংগ ও নেই ।আপনি অযথা এই গুলো চিন্তা করছেন ? আমি এইবার বুঝতে পারলাম ,মেয়েটা থট রিডিং পারে ,সে কোন না কোন ভাবে আমার চিন্তা গুলকে পড়তে পারছে ।মৃন্ময় সাহেব ,আমি কোন থট রিডিং পারি না ,বিশ্বাস হচ্ছে না তো?আপনার পকেটে ১২০ টাকা আছে ,একটা ৫০ টাকা দুইটা বিশ আর তিন টা দশ টাকার নোট।এখন যান ,এই সামনে একটা ঝাল মুড়ি ওলা পাবেন ২০ টাকার ঝাল মুড়ি নিয়ে আসেন আমার জন্য ।এত সকালে এই লোক ঝাল মুড়ি বিক্রি করতে বের হয় না ,কিন্ত আজ বের হয়েছে ,আজ লোকটার মেয়ের জন্মদিন ।মাংশ খেতে চেয়েছে ,টাকা নেই আর আপনি ই হচ্ছেন তার প্রথম কাস্টমার ।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম ।এই মেয়ে বলে কি? আমার পকেটে ১২০ টাকা আছে এই মেয়ের জানার কথা না ,যদি আন্দাজেও বলে তারপর ও নোট কয়টা আছে সেটা জানার কথা না ।তবে সবচেয়ে বেশী অবাক হলাম ,মেয়েটা যা যা বল,তা ই হল ।আমি ঠিক ই একটা ঝাল মুড়ি ওলা কে পাই ,এবং মেয়েটা যা বলএছে সেটাই হয়েছে।রমান উদ্যানে আর এত বেশী ঘটনা ঘটেছে আমি এর কোন খুজে পাচ্ছিলাম না ।তবে ,মেয়েটার সাথে ঘন্টা দুই এক কাটানোর পর ,মেয়েটা বলল, মৃন্ময় আমাকে তুমি মাফ করে দিও ।আমি বিশাল বড় অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে? আমি অবাক হয়ে বলি , কি অন্যায় ।মেয়েটা এই প্রথম আমাকে তুমি করে বলছে আমি সেটা খেয়াল ই করি নি ।মেয়েটা বলল,জানি না ,তবে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও ।আমি আর হয়ত  ,তোমার সাথে আর কয়েক মিনিট আছি ।এই কয়েক মিনিটে তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল ।আমি নিচু গলায় বললাম ,বল ।মেয়েটা বলল ,আমি তোমাকে চিনি ।আমি প্রতিদিন তমাকে জানালা দিয়ে দেখি ,কাছে যেতে চেয়েছি তোমার ।বার বার কাছে যেতে চেয়েছি ।কিন্তু পারি নি ।আজ তোমার কলেজের শেষ দিন ছিল ,তুমি হয়ত চলে যেতে এই জায়গা থেকে তাই আজ না এসে পারলাম না ।ওরা আমাকে আটকে রাখে ,তোমার কাছে আসতে দেয় না ।আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি মেয়েটার দিকে ।কেমন জানি একটা মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি মেয়েটার ।মেয়েটার চেহারা আগের থেকে যেন বেশী মায়াবি লাগছে ।মেয়েটা আবার বলল,আমি অনেক অসুস্থ ,মৃন্ময় ।আমাকে কোন ডাক্তার ভাল করতে পারবে না ।কিন্ত আমার কেন জানি মনে হয় ,একমাত্র তুমি ই পারবে আমাকে অসুস্থতা থেকে ভাল করতে ।আমি বলি,কি হয়েছে তোমার ? মেয়েটা বলল,আমার এক মারাত্নক অসুখ হয়েছে ।পৃথিবিতে খুব কম সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে ,আমি তার মধ্যে একজন ।আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকাই ।কেমন জানি ,এক অদ্ভুদ দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে  আছে ।মেয়েটা বলল,আমি মানুষ কে মায়ায় ফেলতে পারি।যে কোন মানুষ আমার কথায় কেমন জানি মায়ায় পরে যায় ।তাই আমি মানূষের সাথে বেশী কথা বলি না ।কিন্ত যখন দেখলাম তুমি চলে যাবে আমায় ছেড়ে তখন আর পারলাম না ।তোমাকে আমার চাই ,তোমাকে হারাতে পারব না ।তাই সেই ক্ষমতা তোমার উপর প্রয়োগ করলাম ।মৃন্ময় আমাকে মাফ করে দিও ।

আমি চুপ চাপ কথা গুলো শুনছিলাম ।কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না ।মেয়েটা বলল, মৃন্ময় আমি এক বিরল রোগে আক্রান্ত ।বিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে বলে ,Transient global amnesia .যে রোগ হলে মানুষ কিছু মনে রাখতে পারে না।আগের দিন কি ঘটছে ,ঘুমানোর পরে সেটি ভুলে যায় ।ঘুম থেকে উঠার পর আগের দিনের কিছু মনে থাকে না কিন্ত বিশ্বাস কর ,আমি না ,সব ভুলে গেলেও তোমাকে মনে করতে পারি ।প্রতিদিন পারি না ।তবে প্রতি পূর্নিমার রাতে তোমার সব কথা আমার মনে পরে ।আমি বলতে পারব ,তুমি এই দুই বছর কি করেছ না করেছ ।মৃন্ময় প্লিজ ,বিশ্বাস কর আমাকে ।এক মাত্র তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কারো কথা আমার মনে থাকে না ।তাও সেটা আবার পূর্নিমার রাতে ,মৃন্ময় আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ ।ওরা আমাকে ঘরে আটকে রাখে তোমাকে দেখতে দেয় না ।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না ,আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না মৃন্ময় ।মেয়েটা কথাটা বলার সাথে সাথে দেখি ,এক কালো রংগের পাজারো এসে দাড়িয়েছি ।মধ্য বয়স্ক দুই জন লোক ,শুধু বলল,বৃষ্টি গাড়িতে উঠ ।আমি এই প্রথম মেয়েটার নাম জানলাম ,বৃষ্টি । আকাশের বৃষ্টি ,মৃন্ময়ের কাছে পরম আবেশে মিলিত হয় ।মেয়েটি আর কথা না বলে ,চুপচাপ গাড়িতে উঠে পরল ।

আমরা তিন জন লক্ষ্য করলাম ,মৃন্ময় দা কাদছে।পুরুষ মানুষের কান্না নাকি সহজে বের হয় না ,অতি কস্টে ,অতি বেদনায় সেটা প্রকাশ পায় ।মৃন্ময় দা ,বলল, বিগত বিশ টা বছর আমি শুধু ওর স্মৃতিতে একবার ই আসি ।প্রতি পূর্নিমা রাতে ।প্রতি মাসে একবার ।আজ পুর্নিমা ,আজ ও ঢাকা থেকে এইখানে আসবে শুধু আমাকে দেখার জন্য ।সারাটা মাস ও ,ঘরে একা বন্ধি থাকে ,কারো সাথে কথা বলে না ,ঘর থেকে বের হয় না ।শুধু মাত্র একটা দিন আমার সাথে দেখা করবে বলে ।আমাকে কাছে পাবে বলে ।আর আমি ওকে এত ভালোবাসি ,ওর জায়গায় আর কাউকে বসাতে পারব না বলেই আজো অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি নি ।কারন আমি হচ্ছি ,সেই গল্পের রাখাল ,আর ও হচ্ছে আমার প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া মেষ ।

আমরা সবাই ,মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম।আমার চোখ দিয়ে দু ফোটা জল যে কখন গড়িয়ে পরল ,বুঝতে পারলাম না ।হঠাৎ মৃন্ময় দা উঠে দাড়াল ,বলল,আমার সময় হয়ে গেছে ।ও এখন ই এসে পরবে ।আমি যাই ।বলেই বের হয়ে পরল ,লোকটা ।আর আমি আমার শেষ কৌতুহল মিটানোর জন্য পিছু পিছু চলতে থাকি ।রয়েল টিউলিপের সামনে একটা পাজারো এসে দাড়িয়েছে ,কালো রঙ্গের ।

বঙ্গপোসাগর গর্জাচ্ছে ।ঢেউ গুলো আছড়ে পরছে তীরে ।চাদের আলোয় দুই জন নিষিদ্ধ মানব মানবী কে দেখতে পাচ্ছি ।সমুদ্রের পারে ,দাঁড়িয়ে ।প্রকৃতি মাঝে মাঝে কিছু সত্য নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে ,মানুষ কে জানতে দেয় না ।প্রকৃতি আজ অপরুপ সাজে সেজেছে ,এক দিকে পূর্নিমা অন্য দিকে বৃষ্টি ।

প্রকৃতি সব মানুষ কে জানতে দেয় না ,কিছু কিছু নিজের কাছে রাখে ।

                         

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *