কোন এক শীতের সকালে সাদা একটা জ্যাকেট গাঁয়ে দিয়ে কক্সবাজার চাকুরীতে জয়েন করতে হলো। ঘাসের উপরে হালকা হালকা রোদ পরে চিক চিক করছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো দৃশ্যটা। কক্সবাজার এর আগেও আসা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বারই ভ্রমন করতে এসেছি। সাগরে ধাপাধাপি ঝাপাঝাপি করে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। চোখ মুছতে মুছতে ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা করেছি। এবারের যাত্রাটা ভিন্ন, দীর্ঘ সময়ের জন্য কক্সবাজার কাজ করতে হবে গণহত্যার স্বীকার রোহিঙ্গাদের সাথে। প্রথমত ঢাকার বাইরে চাকুরী দ্বিতীয়ত এখানকার ভাষা। কে কি বলছে কিছু বুঝি না। শুধুই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়। এরা বাংলার মতই কি জানি বলে, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় চাইনিজ বলছে। কিন্তু নিজের মনকে সান্তনা দিলাম চাইনীজ বলুক আর — বলুক আমাকে শিখতেই হবে বুঝতেই হবে। মোট কথা টিকে থাকতেই হবে। কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশী বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয় বাসাভাড়া নিয়ে নিজের মনের মত ঘর পাওয়া যায় না এখানে যা পাওয়া যায় তার দাম ও অনেক বেশী। এখানকার মানুষ খুব চালাক, যখন বুঝবে যে আপনি ঢাকার মাল, তখনই পকেট কেটে নিবে আপনার. যখনই বুঝবে যে আপনার এলাকা কক্সবাজার নয় ঠিক তখনই ২০ টাকার আলু ৩০ টাকা হয়ে সাবে ১০০ টাকার মুরগী হয়ে যাবে ১৫০ টাকা। চালাক, অতিব চালাক এই এলাকার লোকজন।
যাই হোক ভাগ্য ক্রমে আমি ভালো বাসায়ই পেয়ে যাই। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট। দুই জন থাকি দুই রুমে। যে যার যার মত ডিউটি করি। আমার রুমমেট ঠিক জানি কেমন? বেশি কথা বলে না, একটার পর একটা সিগারেট খায়। আর আর্টসেলের গান শুনে ফুল সাউন্ড দিয়ে। আমার অবশ্য এই সবে কোন আপত্তি নেই। কে, কিভাবে বলল আমি বলার কে? আমাকে কোন ডিস্টার্ব না করলেই হয়। মনে হয় জীবনের প্রতি কেমন জানি অভক্তি উনার। খুব কম কথা বলে উনি। কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ বা না।
উনার নামটা না হয় আড়াল করলাম। আজ যখন লিখছি, আর কিছুক্ষণ পরই উনি চলে যাবেন। চেষ্টা করছি, তাই কাহিনীটা শেষ করতে দ্রুত। উনার নাম তেজস্বী। হিন্দু ধর্ম। যদিও ধর্ম নিয়ে উনার কোনো মাথাব্যাথা নেই।
পালন যে করে খুব একটা তেমনটাও দেখিনি ,গত কাল এই এক বছরের মধ্যে মনে হয় উনি আমার সাথে সবচেয়ে বেশী একজন (০০০০) একদিন রাত ৯টার দিকে, দুইমগ কফি নিয়ে এসে বলল, কি ব্লগার খবর কী? আমি হেসে জানতে চাইলাম, ব্লগার মানে? তিনি বললেন, গনহত্যা টনহত্যা নিয়ে তো ভালই বলিস। এতো সময় পাও কখন?
আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললাম, এক সময় অনেক পড়তাম সেখান থেকে মেমোরাইজ করে লিখি।
তিনি বললেন আর্মেনীয় টার্মেনীয়া নিয়ে না লিখে রোহিঙ্গা গনহত্যা নিয়ে লেখ। ওদের উপর যে গন হত্যা হয়েছে সেটা নিয়ে লেখা তো তোমার দায়িত্বের ভেতরই পরে, তাই না? তাছাড়া ওদের নিয়েই তো কাজ করো তুমি।
আমি বললাম লিখবো চিন্তা করতেছি, কিন্তু যেহেতু স্পর্শ কাতর বিষয় তার উপর উপরের মহলের নির্দেশ আছে না লিখার। তেজস্বী দা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, সেটা ঠিক। তা লেখক রোহিঙ্গা মেয়েদের কেমন লাগে তোমার ?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, দাদা সবাই তো মানুষ, মানুষ হিসেবে ভালো লাগারই কথা।
উনি বললেন, ধ্যাত, সেই ভালোলাগা না, পেয়ার মহাব্বাত এইসব।
আমি বললাম, কি যে বলেন, দাদা। আপনি জানেন যে, এদের সাথে বাঙ্গালীদের এগুলো সম্ভব না। একে তো সরকার নিষেধ করেছে তার উপর ধর্ম মিলে না, সংস্বৃতি মিলে না, ভাষা মিলে না। এগুলো স্বপ্নেও সম্ভব না। বাংলাদেশ সরকার জানলে ডিম থেরাপী দিবে।
এবার মনে হলো উনি আমার কথায় খুবই রাগ হলেন। কিছুটা জোরেই বললেন, আমি কার সাথে প্রেম করব না করব সরকার কি ডিসাইট করে দিবে? সংস্কৃতি সেটা আবার কি, একজন মানুষ তার সংস্কৃতি নিয়ে থাকুক না তাতে আমার কি? রোহিঙ্গা হয়েছে দেখে কি আমরা বাঙ্গালীরা সব সময় নিজেদের লাট সাহেব মনে করব নাকি, ওদের কি কোন মান সম্মাণ নাই নাকি? নাকি এরা কোন জন্তু, জানোয়ারদের মত?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, দাদা আমি জাস্ট মজা করছিলাম। এতে সিরিয়াস হবার কিছু নেই। তার পর উনি বললেন, আমরা যারা ঢাকায় বড় হয়েছি, পড়াশুনা করেছি। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি, ইংরেজীতে স্মার্ট তাদের সবচেয়ে বড় প্রবলেম হচ্ছে, ইগো। এই ইগোর কারণে অনেক ভালবাসা অতৃপ্ত রয়ে যায়।
আমি বললাম দাদা আমি মজা করছিলাম, সরি। আর করব না।
এবার মনে হয় উনি কিছুটা শান্ত হলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি সরি, অযথা তোমার সাথে রাগ করছি ,আসলে আমার মনটা ভালো নেই, কেমন জানি একটা দো-টানার ভিতরে আছি। নিজেকে কেমন জানি রাজা রাজা মনে হয়। যে রাজা নিজের লেভেলের মেয়ে মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে রাণী বানাতে পারবে না। আবার এক সময় মনে হয় আমি মানুষ অতি সামান্য একজন মানুষ। যার ভিতর রাগ আছে, অভিমান আছে, ভালোবাসা আছে। সামান্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা মেয়েটাকেও সে অনেক ভালোবাসবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা মেয়েটাও। ছেলেটাকে অসম্ভব ভালোবাসবে, ঘর বাধার স্বপ্ন দেখবে।
আমি বললাম, মানে? একটু খুলে বলুন, মোট কথা ঝেড়ে কাশুন। কাল তো চলে যাচ্ছেন, বলেন না আপনার কাহিনী কি? উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে টান দিয়ে, ধোয়া ছেড়ে বললেন, মার্টিন আমি না কেমন জানি হাহাকারের ভিতর আছি।
অদ্ভুদ ধরণের এক হাহাকার ঠিক তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। আমি কোন দিনও সিগারেট খাই না। উনার চেহারা কথা বলার ধরন দেখে আনমনে উনার কাছ থেকে প্যাকেট নিয়ে নিজেই ধরালাম। একজন পেশাদার
সিগারেট খোরের মত সিগারেট টানতে লাগলাম। উনি অবাক হলেন, তবু কিছু বললেন না। আমি বললাম, দাদা কি হয়েছে বলেন না?
এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে কফি। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মার্টিন আমি যখন এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে আসি, আমিও তোমার মতই ছিলাম। ভাষা সংস্কৃতি কিছুই বুঝতাম না। দেশের নামকড়া পাবলিক ভার্সিটির ছাত্র। ভাবই ছিল আলাদা। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আমার সেই ভাব বেশি দিন টিকল না। বুঝলাম বইয়ের পাতা আর বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। আমার আন্ডারে প্রায় ৫০ জন রোহিঙ্গা ভলেন্টিয়ার। আমি ওদের কথা কিছুই বুজি না, মাঝে মাঝে মন চাইত চাকুরী ছেড়ে চলে যাই। এরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে আমার কথা কেউ শোনে না, আমিও কারো কথা বুঝি না। একদম নিরুপায়। হঠাৎ একদিন এক ভলেন্টিয়ার চলে যাওয়ায় এক রোহিঙ্গা মেয়েকে তার জায়গায় নিলাম। কালো রঙ্গের বোরখা পরা। চেহারা দেখিনা। আর আমার এত ইন্টারেস্ট ও নাই, আসলে আমার কেমন খাপ ছাড়া খাপ ছাড়া ভাব। কে আসলো কে গেলো তাতে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই ।
অফিসের প্রসিডিউর ম্যানটেইন করি আর কি? ইন্টারভিউতে যখন জিজ্ঞাস করলাম নাম কি আপনার? বিশ্বাস করো, এতো সুন্দর উচ্চারণ সহকারে উত্তর দিলো আমি অবাক হয়ে গেলাম। রোহিঙ্গা মেয়েদের কোনো ভাবেই ফাইভ এর পর পড়তে দেওয়া হয় না । তারপর আমি বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করলাম, বাবার নাম, মায়ের নাম। মেয়েটা হেসে স্পস্ট বাংলায় বলল, আমার সিভিতে সব লেখা আছে। বিশ্বাস করো মার্টিন, আমি এর আগে এতো অবাক কোনো দিন হইনি কেউ এই প্রথম আমার ধারনা সম্পূর্ণ পাল্টে দিলো মেয়েটি। আগে এদের সমন্ধে আমার যে ধারনা ছিল তা কেনো জানি ভুল হতে শুরু করল। আমি বললাম, স্পস্ট ইংরেজি, বাংলা দুটোই বলতে পারেন, এটা কিভাবে সম্ভব?
মেয়েটি আবার হেসে উত্তর দিলো, আমি হিন্দী, ফ্রাঞ্চ, বাংলা, ইংরেজী, রোহিঙ্গা, উর্দূ এই ৬ ভাষায় কথা বলতে পারি। ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি নিজেই বাংলা, আর ইংরেজী ছাড়া কিছুই পারি না। এমন কি হিন্দীও পারি না। আমি বললাম আগে কোন এনজিও-তে কাজ করেছেন? মেয়েটা বলল, না করিনী। এখানেই করব। এরপর আর করবো না। আমি এবার অবাক হয়ে বললাম, মানে কী?
মেয়েটা মনে হয় হাসছিলো। বুরখার কারণে বুঝতে পারিনি। বলল, পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। আমার কেনো জানি আরো কথা বলতে মন চাচ্ছিলো ওর সাথে। আমি যতই কথা বলছিলাম, ততোই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। তবে অন্য জনদের ইন্টারভিউ থাকায় আর কথা বলতে পারলাম না। তবে বিশ্বাস করো মার্টিন, ওই দিন সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনী। বারবার ওই রোহিঙ্গা মেয়েটির কথাই কেনো জানি মনে পড়ছিলো আমার। অদ্ভুদ সুর, অদ্ভুদ এক চাহনী। পরের দিন অফিস টাইমের আগেই ক্যাম্পে চলে গেলাম আমি। যাবার পর আমি আবার অবাক হয়ে গেলাম আমাদের অফিসের কেয়ার টেকার অফিস খুলে নাই কিন্তু মেয়েটি অফিসের সিঁড়িতে একা বসে রয়েছে দেখে। আমাকে দেখেই মেয়েটা বলল, আপনি ৫ মিনিট দেরী করলেন যে। আমি প্রশ্ন করলাম, মানে? অফিস ৯ টায়, আমি আসলাম ৮:০৫ এ, দেরী মানে? সবার আগে আসছি। মেয়েটা বলল, সিঁড়ির বাম দিকে দেখেন একটা কাগজ আছে আমি কিছু লিখে রেখেছি। দেখেন তো!
আমি কোন রোহিঙ্গাকে এভাবে কথা বলতে দেখিনী। সব সময় একটা ভয় সমিহ কাজ করে ওদের ভেতর অথচ এই মেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি সিড়ির বাম দিকে গিয়ে একটা কাগজ দেখতে পাই। কাগজটির ভাজ খুলতেই আমি হতভম্ব। তাতে লেখা “তেজস্বী দা, আজ আমার জন্য ৮:০০ টায় অফিসে আসবে’’।
লেখা দেখে মনে হচ্ছিল আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই মেয়ে কোনো না কোনো ভাবে আমার মনকে নিয়ন্ত্রন করছে, আমার মনের কথা সে পড়তে পারছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে থাকি। মেয়েটা দুই পা এগিয়ে এসে বলল, ৫ মিনিট দেরী হলো যে। আমি থতমত খেয়ে যাই। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না আমার। শুধু বললাম, আপনি কিভাবে জানেন যে, আমি আপনার জন্য এত সকাল বেলা আসবো?
মেয়েটা হেসে বলল, আমি জানি না, তবে আমার ইনট্যুশন ক্ষমতা অনেক বেশী। সিক্স সেন্স অনেক বেশী কাজ করে। আমি এক অদ্ভুদ প্রশ্ন করে বসলাম, কে তুমি?
মেয়েটি শীতল গলায় বললো, এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ কখনো পায় না, নিজের ভিতর এই প্রশ্ন বারবার করে যায় মানুষ। মানুষ যে আসলে কে, মানুষ তা জানে না। আমি অদ্ভুদ সব কথা, হাসি, চাহনীর বেড়া জ্বালে আটকাতে লাগলাম।
আমি মেয়েটার সাথে যতই কাজ করছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার অফিসের সব কাজ এমনকি এক্সেল, ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট সব কাজ সে করে দিত। আমি লক্ষ্য করতাম, মেয়েটা সারাক্ষণ, আমার সাথে সাথেই থাকত। ভাষা বুঝতাম না অনুবাদ করে দিত। কেও কিছু বললে আমার হয়ে প্রতিবাদ করত। তবে মজার বিষয় হলো, আমি তখনো পর্যন্ত মেয়েটার চেহারা দেখতে পাইনি। অনেক বারই চেষ্টা করেছি। আকার ইঙ্গিতে অনেক বুঝিয়েছি, কাজ হয় নি। মাঝে মাঝে কাজ করতে গিয়ে মেয়েটার হাতে হাত লেগে যেতো। অদ্ভুদ এক শিহরণ, অদ্ভুদ এক অনুভূতি। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম দুই দিন আগে, আমি কোনো দিন ভাবিনী এভাবে এত বড় ধাক্কা খেতে হবে আমাকে। তুমি জান, যে আমাদের রোহিঙ্গা বাড়িতে যেতে নেই, বসতে নেই, খেতে নেই। একদিন সকাল বেলা মেয়েটা এসে বলল, আজকে দুপুর বেলা আমার বাসায় আপনার দাওয়াত।
আমি প্রশ্ন করলাম, কিসের দাওয়াত? রোহিঙ্গা বাড়িতে আমরা যাই না, আপনি জানেন না?
মেয়েটা বলল, যান না তো কি হয়েছে? নিয়ম তো বানানোই হয় নিয়ম ভাঙ্গার জন্য। আজকে যাবেন এটাই শেষ কথা। দুপুর ২টায় পর আর আমি আজ ডিউটি করবো না। ছুটিতে থাকব। আপনি যেহেতু যাচ্ছেন তাই নিজের হাতে আজ আমি আপনার জন্য হাসের মাংস রান্না করবো।
আমি বললাম, ছুটি চাচ্ছেন ভালো কথা কিন্তু এর জন্য আজকের বেতন পাবেন না। মেয়েটা রাগ হয়ে বলল, সারা মাসের বেতন কেটে দেন। আমার যতো টাকা আছে আপনার মত তেজস্বীর দুই জনমে শেষ করতে পারবে ন। অযথা টাকার ভয় দেখাবেন না। আমি গেলাম, ২ টার ভেতরে আসবেন কিন্তু।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই মেয়ে কথা বলছে, কোনো এক অদৃশ্য অধিকার নিয়ে। কেনো জানি মনে হচ্ছিল, এই অধিকার আমি মেয়েটাকে দেই নি। ও নিজেই আমার কাছ থেকে অধিকার আদায় করে নিয়েছে। আমি শুধু চেয়েই থাকি। হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছি, চলাচল করছি। কেউ এমন ভাবে আমর সাথে কথা বলে না। ভয় পায়। এই মেয়ে কেমন জানি এক অধিকার নিয়ে কথা বলে আমার সাথে। একবার মনে করেছিলাম যাব না। কিন্তু বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম, কখন দুইটা বাজবে, কখন বাজবে।
এবার আর ৫ মিনিট দেরী করিনী। ৫ মিনিট আগেই চলে গেলাম। পৃথিবী অবাক, বিস্ময়, কি বলব জানি না আমি। আমি যখন ওদের ঘরে প্রবেশ করলাম, আমার মনে হলো আমি আর এই পৃথিবীতে নেই। নিজের ভেরতটা কেমন জানি তোলপাড় করে উঠলো। কেমন জানি একটা ব্যাথা অনুভূত হলো। চোখে কেমন জানি ঝাপসা দেখতে লাগলাম। গত এক মাস যার চেহারা দেখার জন্য উৎগ্রীব হয়ে ছিলাম। আজ তাঁকে আমি দেখলাম। দেখলাম বললে ভুল হবে, এই রূপে দেখলাম। আজ তাকে আমি দেখলাম, নয়ন ভরে দেখলাম।এই মায়াবী চেহারার বর্ননা আমার মত সাধারন মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। শেক্সপিয়ার এই মায়াবী চেহারা দেখলে হয়ত জুলিয়েটের জায়গায় এর নাম লিখে দিতেন। শাড়ী পড়া। কপালে বড় লাল টিপ।
খোপায় বেলীফুলের মালা। দুই হাতে চুড়ি। আর এত সুন্দর চেহারা আমি কোন দিন দেখিনী। সম্রাট অশোকের পুত্র কুনালের চোখ নাকি অসম্ভব মায়াবী ছিল। আমি উনাকে দেখিনী কিন্তু এই মেয়েকে দেখেছি। আমি জানি না, আমি এমন ভালো কাজ করেছি যে আমার সামনে স্বর্গের পরী চলে এসেছে। মেয়েটা বলল, আসেন, আমার রুমে আসেন। মেয়েটির পাশে তার বাবা মা ছিল। তারাই বললেন, যাও বাবা ওর রুম টা দেখে আসো। আমাদের ওর রুমে যেতে দেয় না। তুমি যাও। তোমাকে দেখাতে চাচ্ছে। সাধারণত রোহিঙ্গাদের ঘর, বাশ দিয়ে তৈরী হয়। ওর বাবা হেড মাঝি থাকায় ওদের ঘরটা সবার থেকে আলাদা।
একটু বড়। সিমেন্ট করা ফ্লোর ইটের গাঁথনী। আমার চোখ বিস্ময়ের পর বিস্ময় নিয়ে শুধু ওর ঘরটা দেখলাম শুধু বই আর বই। বিছানায় অনেক গুলো টেডি বেয়ার, এত সাজানো গোছানো কারো ঘর থাকতে পারে জানা ছিলো না। দুপুরে খাবারের পর মেয়েটি আমাকে বললো, রহস্যের জট খুলে যখন আমি খেতে বসি, মেয়ের বাবাই বললেন সব।
উনার আর উনার স্ত্রীর পরিচয় হয় ভারতে। উনি ভারতের কলকাতায় পড়তে গিয়েছিলেন, যেখানে তাদের পরিচয়। মহিলা হিন্দু তবে উনি তাকে মুসলিম বানান নি। কোট ম্যারেজ করেছিলেন। ওনাদের এক মাত্র মেয়ে। মেয়ের কথা চিন্তা করেই উনার আর সন্তানাদি নেন নি। মেয়েও শান্তি নিকেতন এ পড়াশুনা করেছে। মায়ানমার নিজের এলাকায় যখন যায় এরপরই গনহত্যা চালানো হয়। প্রানের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন। দুই জনই উচ্চ শিক্ষিত। অনেক ঘুরাঘুরি করে, অবশেষে তারা ভারতে যেতে পারছেন। হাতে আর তিন দিন আছে উনারা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবেন। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবেন কথাটা শোনার পর থেকেই কেনো জানি মুখ দিয়ে ভাত ঢুকছিলো না আমার। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো। আমি আর মেয়েটিকে দেখতে পাবো না। নিঃশব্দে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম।
যখন চলে আসব তখন শেষ বারের মত কথা হয় ওর সাথে। মেয়েটি খুব নিচু স্বরে বলল, আমি চলে যাবো আর কোনো দিন দেখা হবে না।
আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটার চোখ কেমন জানি ভরে যাচ্ছিলো। মেয়েটা বলল, আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি, আপনি যে রোহিঙ্গা ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে এত মিশেন ঘুরাঘুরি করেন আমার খুব ভালো লাগত। লক্ষ্য করতাম আপনি আমাদের ভাষা বুঝেন না। কেমন জানি ডিপ্রেশনে থাকতেন, তাই চিন্তা করলাম আপনাকে সাহায্য করতে হবে। সেই ভেবেই আপনার এন.জি.ও -তে চাকুরী নেই। টাকার জন্য না, আপনাকে কাছে পাবার জন্য। আপনি যখন আনমনে থাকতেন আমি ইচ্ছো করেই আপনার হাতে স্পর্শ করতাম। ভাব ধরতাম যেন অনিচ্ছাকৃত ভাবে লেগে গেছে। আমার যে কি ভালো লাগত। আপনাকে কোন দিন বুঝাতে পারবো না। আপনি জানেন না, আপনাকে আমি কি পরিমান ভালোবাসি। পাগল আমি আপনার জন্য। আপনার কাছে দুই দিন সময় রইল। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। আর শুনেন, সোজা চলে যাবেন পিছনে তাকাবেন না। আমি কাঁদবো ,আমার চোখের জল প্লিজ দেখবেন না। আমি কিছু বলি না নিঃশব্দে চলে আসি।
মার্টিন আমি কাল চলে যাবো। সাড়ে ৮ টার বাসে। বাবা, মা আমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। আমি কোনো দিন দেখিনি, দেখার ইচ্ছাও নেই। কারণ আমার জীবনের সব নীলপদ্ম, ওই নাফ নদীর পাড়ের মেয়েটার জন্য। আমি ওই মেয়েটাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আর বাবা মাকে ও ভালোবাসি। জানি না কি করবো আমি।
এতক্ষন আমি চুপ করেছিলাম। এবার জানতে চাইলাম, দাদা আপনার মন কি বলে। আপনি কি ঢাকা বাবা মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবেন, নাকি নাফ নদীর পাড়ের মেয়েটার ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরবেন? উনি শুধু বললেন, জানি না মার্টিন। এই বলে উনার রুমে চলে গেলেন। উনি যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন সেটা বুঝতে পারছি। আজ তেজস্বী দাদা চলে যাবেন। আমি বললাম দাদা আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন? ঢাকা না নাফ নদী ।তিনি শান্ত গলায় বললেন, প্রকৃতি ঠিক করবে। তোমার সাথে আমার আর কোনো দিন যোগাযোগ হবে না। নেট, সোসাল মিডিয়া সব বন্ধ করে দিয়েছি। ভালো থাক।
আমি বললাম, দাদা, আমি একটা কাজ করেছি। আপনার বাসের বিপরীতে একটা সি.এন.জি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। যেটা আপনাকে, আপনার নাফ নদীর পাড়ের মেয়ের কাছে নিয়ে যাবে। আজ প্রকৃতি আপনার সাথে চরম খেলায় মত্ত হবে। আপনি বাস ধরে চলে যাবেন ঢাকা নয় মেয়েটার কাছে যাবেন। যে আপনার জন্য নাফ নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছে।
নিকশ কালো অন্ধকার। ২০০ মিটার দূরে দাদার বাস ঢাকা মূখী আর বিপরীত দিকে একটা সি.এন.জি. নাফ নদী মুখে। দাদা এগিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতি এক নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত। যে খেলায় কে হারে কে জিতে বুঝা যায় না। বৃষ্টি পরবে বলে মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তেজস্বী দা হাত দিয়ে চোখ মুছছে। উনি কি করবেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। হয়ত ঢাকা চলে যাবেন, নয়ত তার নিষিদ্ধ স্বপ্নের বাসরে, নাফের পাড়ের মেয়ের সাথে মিলিত হবে ।
বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি এক অদ্ভুদ ভাষা তৈরি করেছে। সবাই সেই ভাষা বুঝতে পারে না। কেউ কেউ পারে ।