আমার কাছে খুবই স্মৃতি বিজরিত একটা অঞ্চল হলো রাঙামাটিয়া ।যৌবনের প্রথম প্রেম থেকে শুরু করে আট বছর একটা স্কুলে শিক্ষকতার কারনে এই অঞ্চল আমার কাছে নিজের ধর্মপল্লীর মতই মনে হয় ।অবশ্য তুমিলিয়ার সন্তানই রাঙামাটিয়া ধর্মপল্লী ।এক সময় তুমিলিয়ার উপ ধর্মপল্লী ছিল এই ধর্মপল্লী ।ঠিক একশ বছর আগে আমাদের সাথে এই ধর্মপল্লীর বিচ্ছেদ ঘটে । একশ বছর আগের সেই ইতিহাস হয়ত আমি ঠিক মত লিখতে পারব না ।তবে ,চেস্টা তো করতে পারি ।
দোম আন্তনিও পালকীয় কেন্দ্র ,নাগরী ।
আমাদের অঞ্চলে যে ভাবেই হোক ,খ্রীষ্টানীটি নিয়ে লিখতে গেলে এক জন কে কোন ভাবেই অস্বীকার করা যায় না ,তিনি হলেন দোম আন্তনীও ডি রোজারিও।এই লোকটাকে বাদ দিয়ে কোন ভাবেই ভাওয়ালের খ্রীষ্টান ধর্মের ইতিহাস লেখা সম্ভব না ।আমি আমার লেখায় যত বারই ভাওয়ালের ইতিহাস লিখেছি উনাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করেছি ।উনাকে নিয়ে আমার লেখায় ,বার বার বলেছি উনাকে বাদ দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব লেখা সম্ভব নয় । ২০২১ সালে বা কিছু আগে অনেকটাই ক্ষোভ নিয়েই বলেছিলাম ,এই লোকটার নামে কি একটা চায়ের দোকান কি আমরা দিতে পারি না চার্চের পক্ষ থেকে ।দেরীতে হলেও আমার কথাটা চার্চের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ।আজ নাগরীতে উনার নামে পালকীয় সম্মেলন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।চার্চ এই মহান লোকটাকে স্মরনীয় করে রাখতে প্রচেস্টা চালিয়েছে ।
দোম আন্তনীও কে নিয়ে আমার লেখা আছে ।আগ্রহী গন পড়ে দেখতে পারেন ।দোম আন্তনীও এবং ভাওয়ালে খ্রিষ্ট ধর্ম ।ভুষনার এক রাজ পুত্র সব একটা অঞ্চলে একটা ধর্ম প্রচেষ্টায় কি অফুরন্ত সংগ্রাম চালোলো সেটা কি ভাবা যায় ।উনাকে নিয়ে অনেক বার লিখেছি ,তাই আর নতুন করে লিখতে চাচ্ছি না ।মূল আলোচনাটা নস্ট হবে।
একটা সময় নাগরী এবং পাঞ্জোরা দুইটা ধর্মপল্লী ছিল ।আমরা তুমিলিয়া আর রাঙ্গামাটিয়া এই দুই অঞ্চল ।সাধু নিকোলাসের গীর্জা আর সাধু আন্তনীর নামে দুটো গীর্জা ছিল ।সাধু আন্তনীর গীর্জা থেকে পরিচালিত হতো তুমিলিয়া আর রাঙ্গামাটিয়া । ১৮৩৫ সালে বড়দিনের এক রাতে আমাদের এই দুই অঞ্চলের মানুষ বদ্ধ মাতাল হয়ে খ্রীষ্ট যাগে অংশ গ্রহন করেন ।আমি সবসময় নিজের ,শিকড় কে আগলে রাখতে চেস্টা করি ।আমি বার বার ই বলি এই অঞ্চলের খ্রীষ্টানরা নিম্ন বর্নের হিন্দু থেকে কনভার্টেড ।কুমার ,কামার ,জেলে ,মুচি এদের থেকেই আমারা এসেছি ।মদ খাওয়াটা এখনো আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। ১৮৩৫ সালের সেই রাতে ফাদার এই অঞ্চলের কাউকে খ্রীষ্ট প্রসাদ দেন নি ।তাই ক্রোধে এই অঞ্চলের মানুষ গৃহে ফেরত আসে ।
এতে করে চরম অপমানিত হয় এই অঞ্চলের মানুষ।এবং তারা মোটামুটি একধরনের বিদ্রোহ করে।এবং নাগরী ধর্মপল্লী থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিলেন।তাদের এই কর্মকান্ডের পালে হাওয়া লাগায় সেই পর্তুগীজ ভূ স্বামী রবাট দ্যুসে।লোকেরা তার কাছে গেলে তিনি আগুনে ঘি ঢেলে দেন।তিনি তখন কলিকাতার আপস্টলকের কাছে চিঠি লিখে তুমিলিয়ার জন্য ফাদার চান।আপস্টলক তার ডাকে সারা দিয়ে ১৮৩৬ সালে পহেলা জুলাই হিপোলাইট নামক এক জেজুইট ফাদার কে তুমিলিয়ার জন্য পাঠান।এবং একদিন রাত ১০ টার সময় ৪০ জন তুমিলিয়া এবং রাঙ্গামাটিয়ায় মাতব্বর শ্রেনীর লোকের সাথে কথা বলেন। ফাদার তাদের কথা দেন তিনি তাদের ছেড়ে যাবেন না। ১৮৩৬ সালের বড়দিনের দিন তুমিলিয়াতে একটি ছনের গীর্জাতে ফাদার প্রথম তুমিলিয়া এবং রাঙ্গামাটি বাসীর জন্য প্রথম খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করেন।
তবে ১৮৩৭ সালে এই তুমিলিয়া এবং রাঙ্গামাটিয়াকে আবারো নাগরী ধর্মপল্লীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।১৮৪৪ সাল পর্যন্ত তুমিলিয়াতে কোন ফাদার আর খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করেন নি।সেই সময় এই অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার খ্রীষ্টানের বাস ছিল।এই বিপুল সংখ্যক খ্রীষ্টানদের জন্য স্থায়ী চার্চ করার জন্য রবাট দুস্যে ১৮৪৪ সালে ১৩ বিঘা জমি দান করেন। এবং সেখানে একটি চার্চ নির্মিত হয়। ১৮৬৪ সালে সেই চার্চে প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পরে ধবংশ হয়।১৮৯৫ সালে ফাদার এমিল লাফো সি এস সি তুমিলিয়াতে একতালা বিশিষ্ট ফাদার বাড়ি নির্মান করেন ।এরপর সিস্টার গন সেটাকে দুই তালায় রুপান্তরিত করেন ।আমরা যারা পুরাতন তুমিলিয়া স্কুলে কিছু সময়ের জন্য লেখা পড়া করেছি ,আমরা সেই পুরাতন স্টাকচার গুলো দেখেছি।১৯১৩ সালে তুমিলিয়াতে একটি সেমেনারী চালু করা হয় ,যা ১৯২২ সালে তুমিলিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে বান্দুরাতে স্থাপন করা হয় ।আমি অমে প্রানে চাই এই সেমিনারী আবার তুমিলিয়াতে ফেরত আসুক ।কে কি ভাবলো সেটা নিয়ে ভাবি না ।এই অঞ্চলের সেমিনারি এই অঞ্চলেই ফিরে আসুক ।
রাঙামাটিয়া অঞ্চলটি ১৮৩৬ সালের পর থেকে তুমিলিয়ার সাথেই ছিল ।তবে এই অঞ্চলের খ্রীষ্টান গন কোথা থেকে এসেছে সেই সমন্ধে যা জানা যায় তা হলো ,এই অঞ্চলের খ্রীষ্টান গন সর্ব প্রথম জয়রামবের অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে ,যারা মুলত শৈলপুর থেকে আগত খ্রীষ্টান ।রাঙামাটিয়া ধর্মপল্লী প্রায় ১০০ বছর তুমিলিয়ার উপ ধর্মপল্লী ছিল । ১৯২৪ সালে এই অবস্থার পরিবর্তন হয় ।রাঙামাটিয়াকে ১৯২৪ সালে ধর্ম পল্লীতে রুপান্তর করা হয় । ১৮৩৬ এ তুমিলিয়ার সাথে যোগ দিলেও ১৮৯০ এর দিকে তুমিলিয়া থেকে ফাদার গিয়ে এই অঞ্চলে খ্রীষ্টযাগ অর্পন করতেন ।ফাদার লুয়াজ সি এস সি ১৮৯২ সালে রাঙামাটিয়ার বর্তমান কবর স্থানে একটি গির্জা নির্মান করেন ।ওই বছর ১৪ ই নভেম্বর গীর্জা আর্শীবাদ করা হয় এবং নাম করন করা হয় পবিত্র যীশু হৃদয়ের গীর্জা ।এই জায়গায় আমার সবচেয়ে বড় আপত্তি ।যে গীর্জা ১৮৯২ সালে স্থাপিত হয়েছে সেই গীর্জার স্থাপন কাল কেন ১৯২৪ সালে করা হবে ।ধরেই নিলা উপ ধর্মপল্লী ছিল ,তাই বলে কি গীর্জা স্থাপনের সময় টাকেও স্মরন করা হবে না? ১৮৯২ সালের নভেম্বরের ১৪ এই তারিখটা কি রাঙামাটিয়া ধর্মপল্লীর মানুষ কি মনে রাখবে না ?যদিও গীর্জাটি ১৮৯৮ সালে পুরাপুরি ধবংশ হয়ে যায় ।
রাঙামাটিয়া ধর্মপল্লীর কবরস্থান।
১৯০৮ সালে তুমিলিয়ার ফাদার ছিলেন ফাদার এমিল লাফো সি এস সি ।ওনার সাথে রাঙামাটিয়া ধর্মপল্লীর খ্রীষ্ট ভক্তদের সাথে বিরাট এক ঝামেলার তৈরী হয় ।কিন্ত কি কারনে হয়েছিল সেই ঘটনা এখনও অজানা ।এই দুই পক্ষের এই ঝামেলা সামলান ফাদার মাইকেল ফালিজ এবং ব্রাদার টমাস সি এস সি ।তারা দুই জন চট্রগ্রাম থেকে এসে এই ঝামেলা সামাল দেন ।
১৮৯৮ সালে সে গীর্জা নির্মান করা হয় তার ছাদটি ১৯১৮ সালের দিকে হেল পড়তে শুরু করে ।তার ফলশ্রুতিতে সেই গীর্জার টিন গুলো খুলে এনে তুমিলিয়াতে কাটেখ্রীষ্ট সেমিনারীতে লাগানো হয় । বর্তমানে যে স্থানে রাঙ্গামাটিয়া গীর্জাটি স্থাপিত আছে সেটি ক্রয় করা হয় দক্ষিন রাজনগর গ্রামের দেবেন্দ্র মন্ডলের বিধবা স্ত্রী নয়নতারার কাছ থেকে ১৬০ টাকার বিনিময়ে ।এবং সেই জায়গায় ১৯২৩ সালে গির্জা নাম নির্মান করা হয় যার নাম রাখা হয় পবিত্র পরিবারের গীর্জা ।কিন্ত কিছু দিন পর এই নাম পাল্টে আগের নামই বহাল থাকে ,পবিত্র যীশু হৃদয়ের গীর্জা ।
১৯২৪ সালে রাঙামাটিয়া পুরোপুরি তুমিলিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায় ।এই ধর্মপল্লীর প্রথম পাল পুরোহিত ছিলেন ভারতের গোয়া থেকে আগত ফাদার যয়াকিম ডি কস্তা ।তবে ফাদারের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করা হয় । উনি নাকি ,রাঙ্গামাটিয়ার কোন এক মহিলার সাথে অনৈতিক কাছে জড়িত ছিলেন । যিনি এই অভিযোগ করেন ,তিনি ছিলেন একজন পন্ডিত। ফাদারের উপর চাপ বাড়তে থাকে ।এই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের স্কুলে না যেতে বাধ্য করেন সেই পন্ডিত ।পর্যায় ক্রমে সেটি ভয়ংকর রুপ ধারন করে ।স্কুলে শিক্ষাথীর সংখ্যা শুন্য তে এসে দাড়ায়।যারা এই কাজ টির নেতৃত্ব দিচ্ছেল তাদের কে ফাদার খ্রীষ্ট প্রসাদ দিতে অস্বীকার করলেন ।এর প্রতিশোধ হিসেবে রাঙ্গামাটিয়াতে তৈরি হয় ব্যাপ্টিষ্ট মিশন ।রাঙ্গামাটিয়ায় পশ্চিম পাড়ায় ব্যাপ্টিষ্ট মিশন চালু হয় ,এবং চার ভাগের তিন ভাগ ব্যাপ্টিষ্ট হয়ে যান ।
এই ধরনের ঝামেলা দেখে বিশপ যোসেফ ল্যগ্রো ফাদার যোয়াকিম কে ধরেন্ডা মিশনে বদলি করেন ।এবং রাঙামাটিয়াকে আবার তুমিলিয়ার সাথে যোগ করেন ।এবং রাঙ্গামাটিয়াতে ক্যাথলিক গীর্জা পরিচালন করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় ।তখন তুমিলিয়ার পাল পুরোহিত ছিলেন ফাদার ওমের দেরোশ সি এস সি ।তিনি ,যারা রাঙামাটিয়ার ব্যাপিষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাদের বুঝানোর চেস্টা করেন ।এবং তিনি সফল ও হন ।১৯২৯ সালে রাঙ্গামাটিয়া গীর্জার উপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় । ১৯২৯ সালে ফাদার হেনসী সি এস সি রাঙ্গামাটিয়ার পাল পুরোহিত হন ।তিনি যারা ব্যাপ্টিষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাদের সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হন ।শুধু মাত্র পাচটি পরিবার ক্যাথলিক মতে ফেরত আসেনি ।
আর এভাবেই রাঙামাটিয়াতে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার ঘটে ।