ছোট বেলা থেকেই ভাওয়াল আর আঠারগ্রামের খ্রীষ্টানদের মধ্যে অঘোষিত কেমন একটা দুরত্ব লক্ষ্য করে আসছি।সম্পর্ক আছে,আবার থেকেও নেই।।অথচ আমাদের শিকড় কিন্ত একই সুত্রে গাথা।আমরা ভাওয়াল বাসী যে রুট ধরে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলাম, ঠিক সেই রুট ধরে আঠার গ্রামের খ্রীষ্টানগনও খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।আমাদের পর্তুগীজদের দ্বারাই দীক্ষিত হতে হয়েছে।বিবাধটা আমি আজোও বুঝে উঠতে পারি নি।
আঠার গ্রাম অঞ্চলের খ্রীষ্ট ধর্ম সন্ধান করতে গেলে আমাদের সর্ব প্রথম যেতে হবে শায়েস্তা খানের আমলে।পর্তুগীজরা মুঘলদের দ্বারা যেমন নির্যাতিত হয়েছে তেমনি আর্শীবাদিত ও হয়েছে।শায়েস্তা খানের আমলে ঠিক তেমনি একটি আর্শীবাদের ফলে শায়েস্তা খান মুন্সিগঞ্জের উত্তরাংশে, জমি দান করেন। ঢাকা থেকে ছয় ক্রোশ দক্ষিনে এই স্থানের অবস্থান।মোহনগঞ্জের শিকার পুর বা শিকারী পাড়াতে সর্বপ্রথম পর্তুগীজ বসতি স্থাপিত হয়। এবং ধারনা করা হয় এই শিকারপুর থেকেই পর্যায় ক্রমে খ্রীষ্টান বসতির বিস্তৃতি লাভ করে।তবে,এই অঞ্চলে পর্তুগীজরা তেমন ভাবে ধর্ম প্রচারে মন দেয় নাই বলেই প্রতিয়মান হয়।এই অঞ্চলে বরেন্য সর্ব প্রথম যিনি খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন, তার নাম ছিল সূর্যকুমার চক্রবর্তী। উনি কি উপাধী গ্রহন করেছিলেন সেই সমন্ধে জানা যায় না।উনি জোর করেও কাউকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন নি।উনার কথায় এবং কাজে বিমোহিত হয়ে কয়কীর্তন নিবাসী জগন্নাথ চৌধুরীর পুত্র, এবং মালাখানগরের কুলিন বংশ সম্ভুত পূর্ন চন্দ্র বসু নামের আরেক জন অল্প বয়স্ক লোক খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। কিন্ত তিনিও কি পদবী গ্রহন করেছিলেন সেই সমন্ধে জানা যায় না।পর্তুগীজদের আচার আচরন দেখে অনেক নিম্ন বর্নের হিন্দু, এবং অবহেলিত মুসলিমরা গোপনে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করে।তবে শায়েস্তা খানের নির্দেশ ছিল যে, কোন মুসলিমকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা যাবে না। তাই ঐ সকল মুসলমানদের গোপনে ধর্ম চর্চা করতে হতো।
আমি যেহেতু ভাওয়ালের আর মাত্র একবার আঠার গ্রাম যাওয়ার সোভাগ্য আমার হয়েছে,অনেক ক্ষেত্রে আমার নাম ভুল হতে পারে। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিষয়টা দেখার জন্য অনুরোধ করছি।ঢাকার দক্ষিনে কলাকোপা বান্দুরা অঞ্চলের এবং মুন্সিগঞ্জের শোলপুর অঞ্চলকে নিয়ে আঠার গ্রাম অঞ্চল।শোলপুর,তুইতাল,বান্দুরা, মালিকান্দা,ইমামনগর,
নয়ানগর, ইক্রাশী,হাসনাবাদ, বালিডিয়র, বড় গোল্লা, ছোট গোল্লা,নয়ানশ্রী,কাশি নগর,মোলাশিকান্দা,বক্সনগর,দেওতলা এমন কয়েকটি গ্রাম নিয়ে,আঠার গ্রাম অঞ্চল গঠিত। পদ্মা নদীকে কীর্তিনাশা নদী বলার একটি কারন হয়েছে,যে,পদ্মা নদী বিক্রমপুর সহ আরো মুন্সিগঞ্জের অনেক কীর্তিকে নিজের বুকে বিলীন করে নিয়েছে।আর এই অমূল্যবান কীর্তিকে ধবংশ করার জন্য পদ্মাকে কীর্তিনাশা নদী বলে থাকে ওই অংঞ্চলের মানুষ।এই আঠার গ্রামের দুটি গ্রামের বিশাল অংশ পদ্মার ভাঙ্গনে পরে বিলীন হয়ে গেছে।মালিকান্দা এবং নগর কান্দা।
দোম অন্তুনীর সাথে আগষ্টিয়ান ফাদারদের একটি চুক্তি হয়। যেই চুক্তির নাম ছিল নড়িকুল চুক্তি।এই নড়িকুল হলো পদ্মা পাড়ের এক জনপথ। আর যেহেতু অঞ্চলটি পদ্মা পাড়ের ছিল, সেই কারনে বানিজ্য করা সহজ হতো। তাই পর্তুগীজরা এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছিল বানিজ্য করার জন্য।ধর্ম প্রচার তাদের কাছে তেমন একটা প্রাধান্য পায় নি।সত্যি কথা বলতে কি, পর্তুগীজদের এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের চাইতে, দস্যুতামী আর বানিজ্যের প্রতি নজর ছিল।তাই এই অঞ্চলে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার পায় নি।১৬১৮ সাল থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপের দেশ গুলোতে ৩০ বছর যাবত যুদ্ধ হয়। প্রায় ৮০ লক্ষ্য লোক এই যুদ্ধে হতাহত হয়। ১৬৪৮ সালে ২৪ শে অক্টোবর ওয়েস্ট ফেলিয়া নামক এক জায়গায় সমস্ত বিবাদমান পক্ষের মাঝে এক শান্তি চুক্তি হয় যাকে বলা হয় ওয়েস্ট ফেলিয়া চুক্তি।যার ফলে পর্তুগীজরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে আর স্পেন দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশে বানিজ্য এবং ধর্ম প্রচারের সুযোগ পায়। স্প্যানিসরা তাদের ধর্ম প্রচার ঠিক ভাবে করার হলে দক্ষিন আমেরিকাতে ক্যাথলিকদের সংখ্যা অনেক বেশী।পর্তুগীজরা সেই তুলনায় এই ভারতীয় উপমহাদেশে কিছুই করতে পারে নাই। আরেক টা মজার বিষয় হলো,আমাদের বাংলাদেশ আর ভারতীয় খ্রীষ্টানদের অনেকেই Gomes লিখতে Sএর পরিবর্তে Z,রড্রিক্স লিখতে রড্রিগেজ লেখে।আরো কিছু পদবী আছে,তারা জেনে হোক আর না জেনে হোক,এট ভুল করে।আসলে পর্তুগীজ বানানে Gomes এ S লেখে আর স্প্যানিসে Z লেখে।ঠিক তেমনি রড্রিক্স নামটা পর্তুগীজ আর রড্রিগেজ নামটা স্প্যানিস। আর আমারা যেহেতু পর্তুগীজদের মাধ্যমে কনভার্টেট তাই আমাদের নাম পর্তুগীজ হওয়াই শ্রেয়।
দোম আন্তনীর সমন্ধে না বললেই নয়। এই দোম আন্তনী ছিল ভূশনার রাজপুত্র। আমার উনার সমন্ধে বিশদ লেখা থাকায় উনার সমন্ধে বেশি কিছু বলছি না।দোম আন্তনী পর্তুগীজদের দ্বারা অপহরনের স্বীকার হন। পরবর্তীতে ফাদার ম্যানুয়াল নামের একজন ধর্ম যাজকের কাছে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। উনি ফরিদপুরের কোষাভাংগা খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করেন। এবং নিম্ন বর্নের হিন্দু এবং মুসলিমকে অনেক কে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। পদ্মার ভাঙ্গনে এবং মুসলিম শাসকদের নির্যাতনের স্বীকার হয়ে পদ্মার পাড় ধরে নড়িকুলে এসে উপস্থিত হন। এই নড়িকুল এবং হড়িকুল এই দুই জনপদে দোম আন্তনীও তার প্রচার কাজ চালায়। এবং মাত্র কয়েক বছরের ভিতরে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ কে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই হরিকুল, নড়িকুল অঞ্চল পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। এবং এই অঞ্চলের মানুষ জন তখন আঠার গ্রামের বিভিন্ন গ্রামে বসতি স্থাপন করে।
আর এই ভাবে আঠার গ্রামে খ্রীষ্টান বসতি স্থাপিত হয়।
সম্রাট শাহজাহান যখন ব্যান্ডেল চার্চ আক্রমন করে, তখন পর্তুগীজরা এবং সেখানকার স্থানীয় লোকজন নড়িকুলে এসে অবস্থান করে।১৬৮২ সালের দিকে এখানে খ্রীষ্টান লোক সংখ্যা প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজারের মত ছিল।সম্রাট আকবর তার, অবকাশকালীন ছুটি কাটানোর জন্য পাচটি স্থানকে বেছে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিলযার মধ্যে একটি ছিল, হুসেইনাবাদ, যে নামটি পরবর্তীতে হাসনাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
হুগলী থেকে ফাদার রাফায়েল গমেজ নামে এক ফাদার এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করেন।১৭৭৪ সালে হাসনাবাদে প্রথম বানী প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন।এবং বসবাসের জন্য বান্দুরাতে কুটির নির্মান করেন।১৭৭৭ সালে হাসনাবাদে প্রথম গীর্জা নির্মান করেন এবং ফাদার রাফায়েল ছিলেন সেই গীর্জার প্রথম পাল পুরোহিত।প্রথমে ছনের এবং বাশের বেড়া থাকলেও খ্রীষ্ট ভক্তের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে পাকা পোক্ত ভাবে গীর্জা বানানোর তাগিদে ফাদার ব্রিটো ১৮৮৮ সালে পাকা গীর্জা নির্মান করেন।
আর এই ভাবেই আঠারোগ্রাম অঞ্চলে গীর্জা এবং খ্রীষ্টান বসতি স্থাপিত হয়।।
সহায়ক গ্রন্থঃ
সহায়ক গ্রন্থ এবং কৃতজ্ঞতাঃ
১।বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সমাজ-লুইস প্রভাত সরকার।
২।বংলাদেশের খ্রীষ্ট মন্ডলীর পরিচিতি -ফাদার দিলীপ এস কস্তা।
৩।বাংলাদেশের খ্রীষ্ট ধর্ম ও খ্রীষ্ট মন্ডলীর ইতিকথা- ফাদার আলবার্ট টমাস রোজারিও।
৪.ইতিহাসে উপেক্ষিত -তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
৫।বাংলাদেশের খ্রীষ্টমন্ডলী- জেরম ডি কস্তা।
৬।বিক্রম পুর রামপালের ইতিহাস -অম্বিকাচরন ঘোষ ,যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত,হিমাংশুমোহন চট্টোপধ্যায় ।
৭।হিস্টরি অব পর্তুগীজ ইন বেঙ্গল -জোয়াকিম জোসেফ এ ক্যাম্পাস
৮।ট্রাভেলস ইন দ্য মুঘল এম্পায়ার -ফ্রান্সিস বার্নিয়ার ।
সহ আর কিছু সহায়ক গ্রন্থ।।