বাংলাদেশে আমরা অনেক ক্যাথলিক খ্রীষ্টান বাস করি।আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যখন হিন্দু বা মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয় তখন অনেক নিজের নামটাও পরিবর্তন করে ফেলে। তবে নাম পরিবর্তন করলেও সংস্কৃতিটা বদল করতে পারে নাই কখনো।যার ফলে এখনো অনেক হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আমাদের মাঝে রয়ে গেছে।বিয়েতে সিদুর দেওয়া,শাখা পরা,কীর্তন, ধুতি পরা গান বাজনা এইগুলো এখনো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে।তবে ধীরে ধীরে সেইগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। এখন ধুতি পরা বাদ হয়ে গেছে।কেউ ধুতি পরলে খেত মনে করে।অথচ গত ৭০ – ৭৫ বছর আগেও মানুষ ধুতি পরে বিয়ে করত।অবশ্য এখন শাড়ি পরেও বিয়ে করা আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে,অপরাধ। এখন বেশীর ভাগ বিয়েতে মেয়েদের শাড়ি পরতে দেখা যায় না।লেহেংগা,বা গ্রাউন পরে বিয়ে হয়। অনেকটা পাশ্চাত্যে যেমনটা হয়।এমন একদিন আসবে আমাদের মেয়েদের শাড়ি পরে বিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।শাড়ি হয়ত বা যাদুঘরে ঠাই নিবে।মানুষ যতই উপরে উঠুক না কেন, শিকড় ভুলে যাওয়া কখনো উচিত না।যাই হোক,খ্রীষ্টানদের পদবী গুলোর সন্ধান করতে এই লেখাটা। সব পদবীর নাম হয়ত বলতে পারব না প্রধান প্রধান গুলোর বলার চেস্টা থাকবে।
১)কস্তা : কস্তা শব্দের ইটালী,ল্যাটিন, পর্তুগীজ মানে হলো পাজর।স্প্যানিস ভাষায় কস্তা শব্দটি এসেছে কুয়েস্তা শব্দ থেকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী কস্তা পদবীর বাস হচ্ছে,ব্রাজিলে ৭.৬% এর পর পর্তুগালে ৫.২% মোজাম্বিকে ৩.৭%, আমেরিকাতে ১.৯% স্পেনে ১.৫%।বিখ্যাত কয়েকজন ব্যাক্তির নাম হচ্ছে – আফন্স কস্তা – পর্তুগালের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন।জর্জ কস্তা- পর্তুগীজ ফুটবলার। আলবার্ট কস্তা – স্প্যানিস টেনিস প্লেয়ার।পৌলিনুস কস্তা – আর্চ বিশপ, ঢাকা।
২) গমেজ – আমার পদবী।গমেজ শব্দটি এসেছে। এই শব্দটি এসেছে ভিসিগোথ জাতী গোষ্ঠি থেকে যারা প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যে বাস করত।গমেজ শব্দটি এসেছে গামা শব্দ থেকে। যার অর্থ মানুষ।পর্তুগালে ২.৫৭% মানুষের পদবী গমেজ। যার মানে প্রতি হাজারে ২৭১ জন মানুষের পদবী গমেজ। গমেজ পদবীর কিছু বিখ্যাত মানুষ হলো-আন্দ্রে গমেজ – পর্তুগীজ ফুটবলার।
ব্রুনো গমেজ – ব্রাজিলের বিখ্যাত ফুটবলার। ফ্রান্সিস এন্থনী গমেজ – বিশপ,ময়মনসিংহ। অনেক ননক্যাথলিক এবং ইহুদীদের মাঝেও গমেজ নাম প্রচলিত আছে।
৩)পেরেরা – পর্তুগীজ পদবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পদবী হলো পেরেরা। যদিও বাংলাদেশে কম। কিন্ত শ্রীলংকাতে প্রায় খ্রীষ্টানদের পদবী পেরেরা। পেরেরা শব্দরের ইংরেজী মানে হলো নাসপতি বৃক্ষ। ইন্ডিয়াতে,গোয়া,কেরেলাতে পেরেরা নাম বেশ জনপ্রিয়।পর্তুগালে ৪.৮৮ % লোকের পদবী পেরেরা। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যাক্তির নাম -গাব্রিয়েল আন্তনী পেরেরা – উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। টমাস রোমারীও পেরেরা – প্যারাগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শিমন আন্তনী পেরেরা – পাকিস্তানের করাচীর তৃতীয় আর্চবিশপ ছিলেন।
৪)গনসালভেজ – জার্মান্টিক ভাষা থেকে গনসালভেজ নামটি এসেছে বলে ধারনা করা হয় পৃথিবীতে এই ভাষা ভাষি মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটির উপরে। এই নামের অর্থ যুদ্ধ থেকে রক্ষা পাওয়া। পর্তুগালে ২.৭৬ % পদবী হলো গনসালভেজ। ২৯১ জন প্রতি হাজারে। আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, থাইল্যান্ড,সাউথ আফ্রিকাতে এই পদবী বেশি পাওয়া যায়।
৫) রিবেরু -রিবেরু নামের অর্থ ছোট খাড়ি বা নদীর ধার। ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে এই মানের উৎপত্তি হয়। আইবেবিয়ান নামের এক উপতক্যায় ছোট নদী বা খাড়ের কাছে যারা বাস করত তাদের বলা হত রিবেইরো বা রিবেরা। এই অঞ্চলে যারা বাস করত তারা পরবর্তীতে এই উপাধি গ্রহন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে।ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশী এই পদবীর নামের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। বিখ্যাত কয়েকজন ব্যাক্তির নাম হলো- ব্রুনো রিবেরু – পর্তুগীজ ফুটবলার। এন্ডারসন রিবেরু – ব্রাজিলীয় ফুটবলার।ক্যাথরীন রিবেরু – ফ্রান্সের বিখ্যার সংগীত শিল্পী।
৬)রোজারিও – রোজারিও নামটা মূলত স্প্যানিস মানুষদের পদবী। এই পদবীর মানুষেরা স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় থাকতেন।এরা এমন জায়গায় বাস করতেন যেখানে বন্য গোপাপ ফুল ফুটতো।ল্যাটিন শব্দ রোজা থেকে রোজারিও শব্দের উৎপত্তি। রোজারিও শব্দটি পাওয়া যায় ১৩৫২ সালের একটি গবেষনা গ্রন্থে। আর আমেরিকায় এই পদবীর লোক জন পৌছায় জুয়ান দেল রোজারিও নামের একজন স্প্যানিস এর হাত ধরে ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে।বিখ্যাত কিছু ব্যাক্তির নাম-রবার্ট রোজারিও – ইংলিশ ফুটবলার।
জন রোজারিও – আমেরিকার বিখ্যাত গোসপাল গায়ক।জো রোজারিও – আমেরিকান অভিনয় শিল্পী।
৭) ক্রুজ/ ক্রুশ – ক্রুশ বা ক্রুজ শব্দটি যীশুর ক্রুশ থেকে এসেছে। স্পানিশ ভাষায় এর নাম সত্য ক্রুশ। ল্যাটিন ক্রাক্স থেকে ক্রুশ / ক্রুজ শব্দটি এসেছে।ক্রুজ / ক্রুশ পদবী আমেরিকার ৮২ তম জনপ্রিয় পদবী আর সারা বিশ্বে ১৮৬ তম জনপ্রিয় পদবী। প্রায় এক কোটি ফ্যামিলি ট্রি পাওয়া যায় ক্রুশ / ক্রুজ পদবীর।বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গ- টেড ক্রুজ / ক্রুস – মার্কিন সিনেটর।
পেনিলোপ ক্রুজ /ক্রুশ – স্প্যানিস অভিনয় শিল্পী।
সেলিনা ক্রুজ / ক্রুশ- কিউবান আমেরিকান শিল্পী।
৮) কোড়াইয়া – কোড়াইয়া নামটি পর্তুগীজ এবং গালিসিয়ান শব্দ। কোড়াইয়া নামটা বাংলাদেশ আর ভারতে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত। বিশ্বের ৯৪৫২৭ তম কমন নাম।পৃথিবীতে মোট এই পদবীর ৯৯% বাস করে দক্ষিন এশিয়ায়। ল্যাটিন করাইয়া থেকে কোরাইয়া শব্দটি এসেছে বলে ধারনা করা হয়।কোড়াইয়ারা ১১ টি দেশে সবচেয়ে বেশী বাস করে। বাংলাদেশ,ভারত,আমেরিকা কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড,ফিলিপাইন,নরওয়ে ইত্যাদি দেশে এই পদবী পাওয়া যায়।উল্লেখ্য যোগ্য ব্যক্তি বর্গ – ড্যানিয়েল কোড়াইয়া – বিশিষ্ট সমবায়ী,এবং উদ্যোক্তা – বাংলাদেশ।রাউল কোড়াইয়া – এংগোলান ফুটবলার।নাতালিয়ান কোড়াইয়া – পর্তুগীজ লেখক।
৯)পিউরীফিকেশন – বিশ্বের ৪২০৪৫৮ তম ব্যবহৃত পদবী হল পিউরীফিকেশন এবং বিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের মাঝে এক জনের পদবী পিউরীফিকেশন। বাংলাদেশে খ্রীষ্টানদের ৭২১ জনের মাঝে এক জনের পদবী পিউরীফিকেশন।বাংলাদেশের বাইরে ভারত,আমেরিকা, নাইজেরীয়া, সেনেগালে এই পদবীর প্রচলন আছে।
১০) পিরিচ- পর্তুগীজ শব্দ পিরিচ যার অর্থ son of pedro বা son of pero.স্প্যানিস ভাষায় বলা হয় পেরেজ। পেরেজ পদবী সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ব্রাজিলে, পর্তুগালে,মোজাম্বিকে,এংগোলাতে।বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ – ফিলিপ পেরেজ – ব্রাজিলের ফুটবলার।পেদ্রো পেরেজ – কেপ ভাদ্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।এনাবিলা পেরজ – পর্তুগীজ সঙ্গীতএবং অভিনয় শিল্পী।
১১)পালমা- পালমা পদবীর প্রথম খোজ পাওয়া যায় ইটালীর নিপলী শহরে দশম শতাব্দী এবং একাদশ শতাব্দীতে ইটালীর সিসিলিতে এই পদবীর প্রচলন ছিল। ইটালীতে আভিজাত্য বংশ গুলোতে এই নামের প্রচলন শুরু হয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে। পালমা পরিবার গুলো বাস করত নিপলীর প্রদেশের ক্যাম্পানিয়ায় অঞ্চলে বাস করত।পরবর্তীতে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে।পালমা শব্দটি অর্থ এসেছে পাম থেকে মানে তাল ।যা খ্রীষ্টানদের শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গ- টমাস পালমা – সাবেক প্রেসিডেন্ট কিউবা। জোসে পালমা – ফিলিপাইনের বিখ্যাত কবি।এনি ইয়লো পালমা – বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি।
১২) টলেন্টিনু :টলেন্টিনু পদবীটা ইটালীর ম্যাসেরাটা প্রভিন্সের টলেন্টিনু অঞ্চল থেকে এসেছে।সেন্ট নিকোলাস অফ টলেন্টিনু সম্মানে এই পদবী ব্যবহার করা হয়ে থাকে।ফিলিপাইন আর ম্যাক্সিকোতে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করা হয় এই পদবী।আমেরিকার ৩১৮০ তম কমন পদবী টলেন্টিনু। বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ – আব্রাহাম টলেন্টিনু – ফিলিপাইনের রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং ফিলিপাইনের অলিম্পিক কমটির চেয়ারম্যান। জিয়া এঞ্জেলা টলেন্টিনু – আমেরিকার লেখক এবং প্রকাশক।জর্জ টলেন্টিনু – কেপ ভার্দের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি।
১৩) ডি সিলভা- পর্তুগীজ শব্দ সিলভা শব্দের অর্থ কাঠ বা যারা কাঠের মাঝে বাস করে। সবচেয়ে বেশী এই পদবীর বাস ব্রাজিলে ৬৪.৭% এর পরে ৫.৩% সিলভারা বাস করে মেক্সিকো, পর্তুগালে ১.৩৭% বাস করে।উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিবর্গ-আনিবাল কাভাকো সিলভা – সাবেক প্রেসিডেন্ট পর্তুগাল।আশোকা ডি সিলভা – শ্রীলংকার ৪২ তম প্রধান বিচারপতি।লুলা ডি সিলভা – ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট।
১৪) রড্রিক্স : জামার্নিক উপজাতী পঞ্চম এবং অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে স্পেন শাসন করে।সেই উপজাতীর ভাষা থেকে রডিক্স নাম টি এসেছে। Hrodric থেকে এই রড্রিক্স নামের উৎপত্তি। Hrod নামের অর্থ খ্যাতি আর Ric শব্দে অর্থ শক্তি।
আর রড্রিক্স শব্দের অর্থ বিখ্যাত শাসক বোঝায়। বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ – মাইকেল রড্রিক্স – পাকিস্তানের বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড়।ফেরো রড্রিক্স -পর্তুগীজ মন্ত্রী।সুনিত ফ্রান্সিস রড্রিক্স – চীফ অফ আর্মি স্টাফ ইন্ডিয়ান আর্মি।
১৫)ফার্নান্দেজ – ফার্নান্দেজ ২৪৩ তম সবচেয়ে কমন নাম পুরো পৃথিবীতে।এংগোলা,ব্রাজিল আর পর্তুগালে যথাক্রমে তৃতীয়, আঠার তম,এবং দশম কমন নাম।নবম শতাব্দীতে এই পদবীর উৎপত্তি।স্প্যানিস শব্দ ফ্যারোন্যানোদেস থেকে এর উৎপত্তি। ফ্যারো শব্দটির অর্থ যাত্রা আর ন্যানো শব্দের অর্থ সাহসী। সেই হিসেবে ফার্নান্দেজ শব্দের অর্থ সাহসীদের যাত্রা বলা যেতে পারে।উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তি বর্গ – অস্কার ফার্নান্দেজ – ভারতের ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রী ছিলেন।জর্জ ফার্নান্দেজ – ইন্ডিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। এলেক্স ফার্নান্দেজ – ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার।