আমার সবচেয়ে প্রিয় একটি চ্যানেলে ৭১ টিভি একটি প্রতিবেদন তৈরী করছে বখতিয়ার খলজিকে নিয়ে।। নানা রকম কথা বার্তা বলে, কিছু কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ্য করে,প্রমান করতে চেয়েছে যে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মত মহান শাসক আর হয় না।। হিন্দুরা জোর করে তাকে গনহত্যাকারী, লাইব্রেরী ধবংশকারী,নালন্দাকে ধবংশ কারী বানিয়েছেন।। ঘটনা কি আসলেই তাই।
প্রথমে,জানা দরকার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে!!
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়,ভারতের বিহারে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চম শতাব্দীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে ধারনা করা হয়ে থাকে।এটাকে অনেকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত তক্ষশিলার সাথে তুলনা করে থাকে।।তক্ষশীলার কথা বলতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। নালন্দা শব্দটির অর্থ হল দানে অকৃপন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের বিহারে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ৫ম শতাব্দিতে গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্ত প্রতিষ্ঠা করে বলে মনে করা হয়। প্রায় ১৪ হেক্টর জমি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। তিব্বত, গ্রীস, তুরস্ক, পারস্য চীন সহ আরো অনেক অঞ্চল থেকে ছাত্র রা এসে এখানে পড়াশুনা করত।১০০০০ ছাত্রর জন্য ছিল ২০০০ শিক্ষক। প্রতি ৫ জনে একজন শিক্ষক।এই নালন্দার ছাত্ররা এক সময় পাহাড়পুর বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহারে পড়াতেন। বাংলাদেশের এক মহান পন্ডিত,দার্শনিক,যাকে এই প্রজন্ম নাস্তিক পন্ডিত হিসেবে জানে, অতীশ দিপংকর দশম শতাব্দীতে এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরেক জন বাংলাদেশীর নাম না বললেই নয়,অধ্যক্ষ শীল ভদ্র। যার জন্ম ছিল বর্তমান কুমিল্লায়। উনিও এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন।।
এবার বলা যাক, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী সমন্ধে।। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে বই ছিল প্রায় নব্বই লক্ষ। এমন এমন বই ছিল যা ছিল পুরো পৃথিবীতে একটাই। প্রাচীন আয়ুর্বেদ সমন্ধে অনেক গ্রন্থ ছিল এই লাইব্রেরিতে।। এই লাইব্রেরির আরেক নাম ছিল ধর্মগঞ্জ বা ধর্মের হাট।তিনটি বহুতল ভবনে এই লাইব্রেরী প্রতষ্ঠিত করা হয়ে ছিল।তিন টি ভবনের নাম ছিল,রত্নসাগর,রত্নোদধি,রত্নরঞ্জক। এর মধ্য রত্নোদধি ভবনটি ছিল নয় তলা বিশিষ্ট।। আর এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থ,আর প্রাচীন প্রজ্ঞাপারমিতার সূত্রগুলো সংরক্ষন করা ছিল।
এবার আসা যাক,বখতিয়ার খলজি সাহেবের সমন্ধে।।
ইসলামে আল ফিতান : গ্রন্থে বর্নিত আছে যে,নবী মোহাম্মদ বলে গেছেন যে,যে গজওয়ায়ে হিন্দ অর্থাৎ যে,কেউ ভারত আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হবে,তার জন্য আছে বেহেস্ত। এখন এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অনেকেই ভারত আক্রমণ করছেন।এমন একজন হলেন, বখতিয়ার খলজি। বখতিয়ার খলজি যার পুরা নাম ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। জন্ম তারিখ অজানা।জন্ম স্থান হেলমান প্রদেশ আফগানিস্তান। মারা যান ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে।প্রাথমিক জীবনে তিনি একজন সাধারন সৈন্য ছিলেন। কিন্ত দ্রুত বড়লোক হবার চিন্তায়, তিনি বিহারে আক্রমণ করেন। তিনি ধারনা করেছিলেন যে,বিহারে, বিহার গুলোতে প্রচুর ধন সম্পদ পাওয়া যেতে পারে।বাংলায় একটি প্রবাদ আছে,মরলে শহীদ বাচলে গাজী।।তারমানে হলো, মরলে বেহেস্ত, আর বাচলে ধনী।।গজওয়ায়ে হিন্দ।। যাই হোক,এই লোক, নালন্দা সহ আরো কিছু বিহার ধবংশ করার পর, তিব্বত আক্রমণ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান।তবে,ধারনা করা হয়, উনাকে হত্যা করেছিলেন, আলী মর্দান নামের এক জন ব্যক্তি।।
সর্বশেষ আসি, আজকের টপিকে। ৭১ টিভির দাবীর প্রেক্ষিতে কিছু বলতে চাই।স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলার জন্য ৭১ টিভিকে সবচেয়ে বেশী ভাল লাগে আমার।।তবে এই কথা সত্যি যে,মিহিরাকুল এবং রাজা শশাংক বৌদ্ধদের অপছন্দ করতেন। হিন্দু ধর্মের দশজন অবতার আছেন।নয় নম্বর অবতার হলো বৌদ্ধ অবতার। বৌদ্ধ কে একটা সময় মানা হতো না।কিন্ত যখন বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপকতা কমানো যাচ্ছিল না তখন ই বৌদ্ধ কে অবতার হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়।।
যাই হোক,বখতিয়ার খলজির আলোচনায় আসি।১১৯৩ সালে পার্সিয়ান বর্তমান ইরানে মিনহাজ আল সিরাজ জুজজানী নামের এক ব্যক্তির জন্ম হয়। উনার একটি বিখ্যাত বই আছে। বই টি মূলত বাংলায় মুসলমান শাসন কে কেন্দ্র করে লেখা। যার নাম – তবকাত-ই -নাসিরী।এই গ্রন্থে বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম ৫০ বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়।। ৩৪ বছর বয়সে তিনি ভারত বর্ষে আসেন এবং তার বিখ্যাত গ্রন্থ তবকাত -ই-নাসেরী লিখেন।।মিনহাজ আল সিরাজ বাংলায় দুই বছরের মতন ছিলেন।এখানে এসে বখতিয়ার খলজির শিষ্যদের সাথে সরাসরি কথা বলে বখতিয়ার খলজির সমন্ধে লিপিবদ্ধ করেন।। উনার তবকাত -ই -নাসেরী বইয়ে ( কেউ যদি চান আমার কাছে পিডিএফ আছে, চাইলে দিতে পারব) ১৯ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন যে খলজি সাহেবের দুই জন একান্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন,একজনের নাম নিজাম উদ্দিন আরেক জনের নাম সামসউদ্দিন। তাদের কাছ থেকে ৬৪১ হিজরীতে যে তথ্য জানেন যে,”দুর্গা পুরে উপস্থিত হবার পর প্রবল আক্রমণ শুরু হল।মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির দু:সাহসিক ধর্ম যোদ্ধাদের নিকট দুই ভ্রাতা ছিল।( নিজাম উদ্দিন আর সামসউদ্দিন)। স্বীয় শক্তি ও সাহসের বলে,এই দুর্গদ্বারে ভেদ করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তার সৈন্যগন, দুর্গ দখল করে,এবং অনেক দ্রব্য
লুন্ঠন করে। এ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল ব্রাম্মন। তাদের মস্তল মুন্ডিত ছিল।তাদের সকলেই হত্যা করা হয়েছিল।সেখানে অনেক গ্রন্থ ছিল।যখন বহুসংখ্যক গ্রন্থ মুসলামদের দৃষ্টিতে পড়ল তখন উপস্থিত ব্যক্তিগনকে গ্রন্থে লিখিত বিষয়ে মর্মোদ্ধারের জন্য আহবান করা হলো এবং এক ঘোষনা প্রচার করা হলো।সকলেই নিহত হয়েছিল।যখন পুস্তক মর্মোদ্ধার করা হলো তখন জানা গেল যে,সমগ্র নগর,ও দুর্গ নিয়ে একটি শিক্ষায়তন ছিল।’”( তাবকাত- ই -নাসেরী পৃষ্ঠা নাম্বার ১৯ থেকে ২০)
এখানে উল্লেখ্য যে,মিনহাজ আল সিরাজ বাম্মন আর বৌদ্ধ দের এক করে ফেলেছিলেন। তাই তিনি বৌদ্ধ সন্নাসীদের বাম্মন হলে অবহিত করেছিলেন।৯০ লক্ষ বই ছয় মাস ধরে পুড়িয়ে ছিলেন বখতিয়ারের সৈন্যরা।।