এখানে বসেই লেখা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অনেক নিদর্শন।।

ছোট বেলায় বইতে পড়েছি, যে,পর্তুগীজ যারা ডাকাতি করত তাদের কে বলা হত ফিরিঙ্গী।যার অর্থ নাকি ডাকাত। আর মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্রায় খ্রীষ্টান কে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে আমাদের ডাকে ফিরিঙ্গী। আমাদের এলাকায় এক ধাপ এগিয়ে বলে মাইডা ফিরিঙ্গী। ফিরিঙ্গী শব্দটা আমাদেরকে অপমান করার জন্যই বলা হয়ে থাকে।এই বলে বলে আমাদেরকে বুঝানো হয়,তোরা ডাকাতের বংশধর।আসলেই কি আমরা ডাকাতের বংশধর?ফিরিঙ্গী কাদের বলা হতো,না জেনে শুনেই না বুঝেই আমাদের এই নামে ডাকা হয়।
১৫১৪ সালের ২৭ শে জুন পোপ দশম লিও এবং পর্তুগীজ রাজার মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদন হয় একে বলা হয় পাদ্রোয়াদো পর্তুগীজ বা পর্তুগীজ পৃষ্টপোষকতা চুক্তি।এই চুক্তির ফলে,পর্তুগীজরা ভারতে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পান। ভারতে নতুন ধর্ম প্রদেশ, বিশপ নিয়োগ এমন কি যাজক পর্যন্ত পর্তুগালের রাজার অনুমতি ছাড়া ভারতে পাঠানো যাবে না।পক্ষান্তরে,ফাদারগন পর্তুগীজ জাহাজে করে ভারতে আসবে তাদের সমস্ত রক্ষনাবেক্ষন থেকে শুরু করে পর্তুগীজ রাজা বহন করবে।এখন কথা হচ্ছে,যারা পর্তুগীজ জাহাজে করে আসতো তারা তাদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আসতে পারত না।স্বভাবতই, এত দিনের জন্য ভারতে আসা, কিছুটা হলেও কামনা বাসনা জাগ্রত হত নাবিক এবং সৈন্যদের।তারা সুযোগ পেলেই ভারতীয় নারীদের অত্যাচার করত।পর্তুগীজ রাজকীয় আইন ছিল যে কোন পর্তুগীজ ভারতীয় কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। এই অত্যাচারের ফলে গোয়ায় ভাইস রয় আল বাকার্কের কাছে স্থানীয় লোকেরা বিচার দিলে ভাইসরয় এই কথা রাজা ম্যানুয়েলের কাছে জানান।অবশেষে বাধ্য হয়ে রাজা পর্তুগীজদের ভারতীয় নারীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়। আর এখানে অবস্থিত পর্তুগীজরা হিন্দু এবং মুসলিম মেয়েদেরকে বিয়ে করে থাকে।এখন সেই পর্তুগীজ পিতা আর ভারতীয় মাতার মিলনের ফলে যে শিশু ভুমিষ্ট হতো তাদেরকে বলা হতো ফিরিঙ্গী।কিন্ত বাংলাদেশে খ্রীষ্টানদের ছোট করার জন্য পাঠ্যপুস্তকে লেখা হলো ফিরিঙ্গী মানে জলদস্যু।এই কাজটা খুব জগন্য ভাবেই করা হয়েছে।যেমন টা করা হয়েছে গারোদের সাথে।ছোটবেলায় বই পড়তে গিয়ে দেখতাম লেখা আছে,গারো উপজাতিদের (আমি উপজাতি বলার পক্ষপাতী নই,উপ কোন জাতী হতে পারে না) প্রিয় খাবার নাকি কুকুর। অবজেক্টিভ প্রশ্নে থাকত গারোদের প্রিয় খাবার কি, আমরা দাগিয়ে আসতাম “কুকুর”। আজ পর্যন্ত কোন দিন শুনি নাই গারোরা আদো কুকুর খায়। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এইভাবেই সংখ্যালঘুদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে।যাই হোক,আমি এই বিষয় নিয়ে লিখতে আসেনি।বাংলাদেশে খ্রীষ্টানরা আসলো সেটা জানাতে এসেছি।

ভারতে খ্রীষ্টানরা প্রথম আসে যীশু খ্রীষ্টের কয়েকবছর পরেই।যীশু খ্রীষ্টের শিষ্য সাধু টমাস ভারতে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করেন।সাধু টমাস কিন্ত এমনি এমনি ভারতে আসেনি। উনাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।আমরা জানি, আমাদের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে,নালন্দা।কিন্ত নালন্দার আগেও এই অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সমন্ধে ধারনা পাওয়া যায়। আর সেটা হচ্ছে,বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলা।এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত। এখনকার এক রাজা, রাজা পহ্লব রাজা গন্ডোফারনেস, তার রাজ্যকে সুসজ্জিত করার লক্ষ্যে হব্বন নামের এক ইহুদী বনিকে জেরুজালেম তথা ইস্রায়েলের পাঠান।আগে থেকেই এই অঞ্চলে ইহুদীরা বসবাস করত। ব্যবসা বানিজ্য করত। সেই হব্বন ছিল ধর্মমতে ইহুদী। কিন্ত তিনি যখন আসলেন,তখন সাধু পিতর রীতিমতো খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারে ঝড় তুলেছেন।কথায়,যুক্তিতে, মাধ্যুয্যতায় সবাই কে বিমোহিত করছিলেন।সাধু পিতরের কথায়,উনি ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করেন।বাইবেলের সেই উক্তিটি আমরা সবাই জানি,যাও,তোমারা সমগ্র মানব জাতীর কাছে,আমার কথা প্রচার কর,তাদেরকে পিতা পুত্র পবিত্র আত্নার নামে দীক্ষাস্নাত কর। সেই হিব্বন নামের নব্য খ্রীষ্টান যখন সাধু টমাস কে অনুরোধ করলো ভারতে আসার,তখন যীশু খ্রীষ্টের কথামত, সাধু পিতর আসলেন ভারতে। সাধু টমাসের অনেক আশ্চর্য কাজ চোখে দেখার পর পাঞ্জাবের রাজা গন্ডোফারেনেস নিজ পরিবার সহ খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেন। বলা যেতে পারে,উনিই প্রথম কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি প্রথম খ্রীষ্টধর্ম গ্রহন করেছিলেন। এর পর পহ্লব রাজবংশের পতন ঘটলে কুষান রাজারা ক্ষমতা নেয়। তারা এসে বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে,আর এই ভাবে আস্তে আস্তে ভারতে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হবার জোয়ার বন্ধ হয়ে যায়। যারা ছিলেন শেষ পর্যন্ত, তাদেরকে “থুমা ভগত” নামে সম্বোধন করা হতো। মানে টামাস থেকে থোমা। থোমার শিষ্য।।যাই হোক আমি যেহেতু বাংলাদেশের, তাই ভারতে কিভাবে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার হয়েছে,তার থেকে বাংলাদেশে খ্রীষ্টধর্ম আসলো সেটা আমার বিবেচ্য বিষয়।।

আজকে ২৩ শে মে।আর চারদিন পর ২৭ শে মে ১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা এই মালাবার কালিকটে আসেন।শুরু হয় ভারতে নতুন করে খ্রীষ্টধর্মের যাত্রা।এখন প্রশ্ন বাংলাদেশে কখন খ্রীষ্টনরা আসে? বাংলাদেশে খ্রীষ্টান রা আসে ১৫১৭ সালের নবাব হোসেন শাহের আমলে।যিনি প্রথম আসেন উনার নাম ছিল কোয়েলহো।তিনি সর্বপ্রথম ব্যবস্যা করতে চট্রগ্রাম আসেন। এর পর আসেন সিলভারো নামের আরেক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী। উনি আসেন ১৫১৮ সালে।আর ১৫২৮ সালে দ্য মেল্লো নামের আরেক জন পর্তুগীজ ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী যিনি ব্যবস্যা করতে এসে গৌড়ের অধিপতির কাছে সাজাপ্রাপ্ত হন।পর্তুগীজদের কাছে দুইটি জায়গা বেশ সমাধৃত হতে থাকে।এক,চট্রগ্রাম দুই হুগলী।আমি হুগলী নিয়ে বলতে বেশী আগ্রহী না,কারন আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ কেন্দ্রিক। ১৫৩৭ সালে, পর্তুগীজরা চট্রগ্রামের দিয়াং এ সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে।।চট্রগ্রামের খুব কাছেই ছিল আরাকান রাজ্য।আরাকান রাজারা খুব সাচ্ছন্দ্যই পর্তুগীজদের গ্রহন করেছিল।কিন্ত সেই সু সম্পর্ক বেশি দিন টিকে নি।চট্রগ্রামের দক্ষিনে মেঘনা নদীর মোহনায় লবন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত দ্বীপ সন্দীপ। এই দ্বীপকে কেন্দ্র করেই মুলত অবিশ্বাস শুরু হয়। এই দ্বীপের উপর পর্তুগীজ, আরাকান রাজা,আর মোঘল সম্রাটদের দৃষ্টি পরে।আর এই দ্বীপ ছিল রাজা কেদায় রায়ের অন্তভুক্ত। উনি একজন পর্তুগীজ নাবিক ডমিঙ্গো কাভোর্লো নামের একজন কে শাসন করতে দেন। ডমিঙ্গ কাভোর্লো ছিলেন একজন দক্ষ নৌ যোদ্ধা। উনিই জন্ম দিয়েছিলেন,বাংলাদেশে খ্রীষ্ট মন্ডলীর পিছিয়ে পরার এক যুদ্ধের।”সন্দীপের যুদ্ধ”।

এবার আসা যাক,বাংলাদেশের প্রথম গীর্জার সন্ধানে।। ১৫৯৮ সালের ১ লা অক্টোবর তিন জন ফাদার, ফাদার ফার্নান্দেস,ফাদার ডি সুজা আর ফাদার ফ্রান্সিকো চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে হুগলী থেকে রওনা দেন। পথের মধ্যে তার যান যশোহরে।রাজা প্রতাপাদিত্য এর রাজ দরবারে।রাজা তাদের তার রাজ্যে সেবা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কারন তিনি এরই মধ্যে অবগত ছিলেন, জেজুইট ফাদারদের ত্যাগ এবং পান্ডিত্যের কথা।কিন্ত ফাদারগন উনার উনার সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে,রওনা হন চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য।অবশ্য রাজার সেই অনুরোধ রক্ষার্থে, ১৫৯৯ সালের মে মাসে প্রতাপাদিত্য এর রাজদরবারে হাজির হোন, ফাদার ডি সুজা। তখন যশোহরের রাজধানী ছিল চাঁদ কান।রাজা এতে খুব খুশি হন।ফাদার ডি সুজার বিনম্র ব্যবহারে তিনি তার রাজ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে অনুমতি দেন। এবং ফাদার কে আর্থিক সাহায্য ও করেছিলেন।কিছু দিনের ভিতর ফাদার দুইশ হিন্দু মুসলিমকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। রাজা প্রতাপাদিত্য এর রাজত্ব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে,ফাদারের একার পক্ষে সেই এলাকায় খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করাটা কস্টসাধ্য ছিল। ফলে ফাদার ডি সুজা ফাদার ফার্নান্দেস কে চিঠি লিখেলেন যেন ফাদার ফ্রান্সিসকো কে যশোহরে প্রেরন করেন। ফাদার ফ্রান্সিসকো অবশেষে সেই ডাকে সারা দিয়ে তৎকালীন বাকলা আর বর্তমানের বরিশালে এসে হাজির হন।এখানে আগে থেকেই কিছু সংখ্যক পর্তুগীজ নাবিকদের বসবাস ছিল।তাদের সাহায্যে ফাদার ততৎকালীন বাকলার রাজা রামচন্দ্রের সাথে দেখা করেন। রাজার বয়স ছিল ৭ কি ৮। উনি ফাদারের ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ হোন যে,তিনি তাকে বাকলায় থেকে যেতে বলেন। কিন্ত ফাদার ফ্রান্সিসকো বাকলায় না থেকে ১৫৯৯ সালের ২০ শে নভেম্বর যশোহরে রাজা প্রতাপাদিত্য এর রাজদরবারে হাজির হন। রাজা তাকে সাদরে গ্রহন করে নেন।ফাদার ডি সুজা আর ফ্রান্সিসকো মিলে যশোরে প্রথম গীর্জা স্থাপনের কথা চিন্তা করলেন।রাজা তাদের ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে,তিনি তাদের কে, তার রাজ্যে গীর্জা স্থাপনের অনুমতি দিলেন এবং তাদের কে ইছামতী নদীর তীরে ঈশ্বরীপুরে জমি দান করলেন। শুরু হলো বাংলাদেশে প্রথম গীর্জা নির্মানের কাজ। এই গীর্জা নির্মানে স্থানীয় পর্তুগীজরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন। ফলে দ্রুতই একমাসের মধ্যে গীর্জার কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেলো।।সেই গীর্জার নাম করন করা হলো যীশুর গীর্জা।সেই গীর্জা ১ লা জানুয়ারী ১৬০০ সালে মহা ধুমধামের সাথে উদ্ভোদন করা হয়। আর প্রথম বাংলাদেশে কোন গীর্জায় খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করা । প্রতাপাদিত্য সেই গীর্জা প্রদর্শন করেন। রাজা গীর্জার কারুকার্য দেখে খুশি হন এবং ফাদারকে পাথর দিয়ে গীর্জা বানানোর অনুমতি দেন। তিনি এমন একটি গীর্জা করতে বলেন যেটি হবে ভারত বর্ষের সব চেয়ে সুন্দর গীর্জা। এর পরের দিন গীর্জা দেখতে আসলেন রাজা প্রতাপাদিত্য এর ছেলে,এর পরে হাজার হাজার মানুষ সেই গীর্জা পরিদর্শন করেছিলো। যাই হোক সেই গীর্জা পরবর্তীতে ধবংশ হয়েছিল।এখনো ইশ্বর পুরে কয়েকটি ঢিবি সেই গীর্জার স্মৃতি নিয়ে আজো বেচে আছে।

পরিশেষে, আরেক তথ্য দিয়ে শেষ করি,বাংলাদেশ প্রথম ফাদার হয়েছিল রাজা কেদার নাথের রাজ্য থেকে। তার রাজ্যত্ব ছিল শ্রী পুরে। যেটাকে বিক্রম পুর নামে চিনি আমরা। এই বিক্রম পুর থেকে ফাদার ফার্নান্দেজ চার জন মেধাবী ছাত্রকে বাচাই করে গোয়ায় সেমিনারীতে প্রেরন করেন। তাদের মধ্যে একজন ফাদার হয়েছিলেন। তার নাম ছিল,ফাদার ম্যানুয়েল গ্রাসিয়া।।তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙ্গালী ফাদার। সম্রাট শাহাজাহান ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে হুগলীর ব্যান্ডেল চার্চে আক্রমন করেন। তখন অনেক খ্রীষ্টান নারী পুরুষদের বন্ধি করেন। সেই বন্দিদের মাঝে ছিলেন ফাদার ম্যানুয়েল গ্রাসিয়া।সম্রাট শাহাজাহানের নিষ্ঠুর সৈন্যগন এতটাই নির্যাতন করে যে,ফাদার ১৬৩৪ সালে ২৩ শে মার্চ মৃত্যু বরন করেন,আগ্রাতে।ফাদারের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, পরে কয়েকজন খ্রীষ্টভক্ত সেই লাশ তুলে এনে সমাধিস্থ করে, আগ্রাতে।বংগালী প্রথম ফাদারই ধর্মের জন্য শহীদ হন।

One thought on “বাংলাদেশে খ্রীষ্টানদের শিকড়ের খোজে।।জেরী মার্টিন গমেজ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *