marriage proposal, commitment, full moon-7765076.jpg

নজরুল ঠিকিই বলেছিলেন,তিনি এমন অনেক যুবককে দেখেছেন যারা যৌবনের আভায় উজ্জেবিত না হয়ে প্রাচীন, পুরনো মানুষের মত আচরন করে।আবার তিনি এমন ও অনেক কে দেখেছেন,যাদের পড়ন্ত বিকেলেও জ্বল জ্বল করে উঠে যৌবনের রাজটিকা।বার্ধক্য যাদের কোন দিন ও স্পর্শ করতে পারে না।। আজ, হঠাৎ করেই একটা ফোন আসল।সাধারনত অচেনা কোন ফোন রিসিভ করি না।ভাল লাগে না।তারপর ও আজকের ফোন টা কেন জানি ধরতে মন চাইলো।নিজেকে একা একা লাগে সবসময়। বাড়ি ঘর,পরিবার ছেড়ে এত দূরে থাকি কারো সাথে কথা বলতে পারলে ভালই লাগে।।

হ্যালো বলতেই ও,পাশ থেকে একটা আওয়াজ বলল,তুমি কি মার্টিন বলছ?
কথার ধরনের বুঝলাম, ভদ্রলোকের বয়স বোধ করি ৭০ এর উপরে হবে।। সাধারনত অপরিচিত কেউ তুমি বললে বিরক্ত হই।নামকরা স্কুলের টিচার ছিলাম।ছাত্র থেকে ৭০-৮০ বছরের মানুষ ও আপনি করে বলত। সেটাই অভ্যাস হয়ে গেছে।কিন্ত আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম,ভদ্র লোকের তুমি বলাটায় কেমন জানি এক মায়া জড়িয়ে আছে।কেমন জানি শীতল একটা কন্ঠস্বর। এই কন্ঠস্বর যে, যে কাউকে এক সেকেন্ডে আপন করতে পারে, তা কেউ না জানুক আমি বুঝতে পারি।কেমন জানি মাদক মিশ্রিত ভয়েজ।।

আমি খুব শান্ত ভাবে বললাম,জি বলছি।
ভদ্রলোক আমার থেকেও শান্ত ভাবে বলল,তোমার সাথে কি দুই মিনিট কথা বলা যাবে?

আমি বলি,বলতে পারেন। দুই মিনিট না,চাইলে আরো বেশী সময় বলতে পারেন?

ভদ্রলোক হাসলেন। ফোনে হয়ত বা তার হাসি দেখতে পাচ্ছি না।তবে মনে হচ্ছে ওডিসি লেখার পর হোমার যে তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন, ঠিক তেমনি হাসি।ভদ্রলোক বললেন,তোমার নাম্বার টা তোমার আর আমার কাছের একজন দিয়েছে।বলল,তুমি কক্সবাজার থাক।আমি আমেরিকাতে থাকি, কয়েকদিনের জন্য কক্সবাজার যাব। তুমি কি আমাদের কোন ভাবে হেল্প করতে পারবে?আমি এই কাজটা করতে আসলেই খুব পছন্দ করি।এলাকার কেউ আসলে দেখা হবে,নিজের ভাষায় কথা হবে,ভাবতেই ভাল লাগে।আমি বললাম,অবশ্যই করতে পারব। কিন্ত আমি গরীব মানুষ।। ফিনান্সিয়াল ভাবে তত একটা করতে পারব বলে মনে হয় না।
ভদ্রলোক এবার হো হো করে হেসে উঠলেন, মনে হচ্ছে অনেক বছর ধরে তিনি এভাবে হাসেন না।।বললেন,ইয়াং ম্যান, তুমি কার সাথে কথা বলছ তুমি তা জান না।এই দেশের আমাদের সমাজের এই জন স্বনামধন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলছ।।স্বনামধন্য,বলাতে আমাকে আবার অহংকারী মনে করো না ইয়াং ম্যান। তোমাকে বুঝানোর জন্য বলা।আমি যাব,অনেক বছর আগে গিয়েছিলাম, এখন আর তো আগের মত নেই।তুমি থাকলে আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখালে।গাইড এর মত।। তোমার ছুটির দিনেই যাব।আর তোমার জন্য অফিস কামাই করতে হয়, আমি তোমাকে পে করতে রাজী আছি।তুমি কি আমাকে সময় দিবে, ইয়াং ম্যান।

আমি নিজের কথাই নিজেই নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম।বললাম,আংকেল আমি দু:খিত।না বুঝে বলদের মত কথা বলে ফেলেছি।আমার ঠিক হয় নি। আমি থাকব, আপনার যতদিন লাগবে,আমি ছুটি নিব।আমার পেইম্যান্টের দরকার নেই।।
ভদ্রলোক বললেন,তুমি ছুটি কবে পাবে সেটা বল।

আমি বললাম,ইদের ছুটি আছে পাচ দিন। আপনি এসে পরুন না।
ভদ্রলোক বললেন,চিনব কি ভাবে তোমাকে?
আমি এবার হাসলাম,আংকেল আমরা তো আর হঠাৎ বৃষ্টির জগতে নাই।আমি আপনার মেসেজ্ঞারে আমার ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি।।
ভদ্রলোক ওনার বিখ্যাত সেই হাসি হাসলেন,বললেন ইয়াং ম্যান তুমি ঠিকিই বলেছ।বয়স হয়েছে না।আর কত?এই প্রথম কোন বয়স্ক লোকের সাথে কথা বলে, আমার এত ভাল লাগছে।।সারাক্ষন আত্ন চিন্তায় মগ্ন বৃদ্ধের আমার খুবই বিরক্ত লাগে। মনোবিজ্ঞানী বলি আর যাই বলি এই জন্য সিগমুন্ড ফ্রয়েড কে আমার খুব ভালো লাগে।ভদ্রলোক খুব সহজেই মানুষকে বোঝার কৌশল বাতলে দিয়েছেন। আমার ইনট্যুশন ক্ষমতা কেন জানি মনে হয় একটু বেশী। সিক্সথ সেন্স অনেক বেশী কাজ করে।।এয়ারপোর্টে যখন গেলাম,তখন যাকে আমি রিসিভ করতে গিয়েছি,তাকে দেখে আমি রীতিমতো অবাক, সত্তর উর্ধে একজন বৃদ্ধ নিজেকে কি ভাবে এত ফিট রাখে বুঝলাম না।জাপানে এক ধরনের খাবারের মেন্যু প্রচলন আছে,যা ফলো করলে মানুষ খুব সহজেই অনেক বছর বাচতে পারে। তবে কেন জানি জাপানীরা এত বছর বাচতে চায় না।আত্নহত্যা করে।মানুষ কেন আত্নহত্যা করে, আমি বুঝতে পারি না।তবে, মানুষ ছাড়াও, তিমি,হাংগর, কুকুর ও আত্ন হত্যা করে।ইন্দোনেশিয়া এবং মালোয়শিয়া তে এক ধরনের ইদুর গোত্রীয় প্রানী আছে,যাদের বলা হয় লেমিং।এই প্রজাতিও আত্নহত্যা করে।এই ইদুর গুলো, বছরে একবার বাচ্চা দেয়।কিন্ত বাশের এক ধরনের ফল হয় যা প্রতি পঞ্চাশ বছর পর পর হয়।ওই ফল খাবার পর এরা বেশী বেশী বাচ্চা প্রসব করে।ফলে এদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন এরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আত্নহত্যা করবে।তখন দল বেধে এরা সমুদ্রের দিকে যায়, আর এক সাথে ঝাপ দিয়ে আত্ন হত্যা করে।ভদ্রলোক যখন, ডাক্তার, উনাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করব, কেন মানুষ আত্নহত্যা করে।চিকিৎসা বিজ্ঞান কি বলে?

ভদ্রলোক নেমেই, আমার দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন,মার্টিন কেমন আছ তুমি।

ভদ্রলোকের সাথে উনার স্ত্রী।উনাকে দেখে মনে হচ্ছিল ভদ্র মহিলা প্রচন্ড রূপবতী একজন মেয়ে ছিলেন। হয়তো নিজ এলাকার সেরা রূপবতী মেয়ে ছিলেন।অনেক টা হেলেন অফ ট্র‍য় অথবা মিশরের রানী ক্লিউপেট্রার মত। ভদ্রমহিলার চোখ দুটি অনেক সুন্দর।।কি জানি যৌবনে আর কত সুন্দর ছিল।ইংরেজ কবি শেলীর চোখ নাকি অনেক সুন্দর ছিল।শুধু পড়েছি,দেখে নি।আমার ধারনা ভদ্রমহিলার চোখ দেখলে শেলীও লজ্জা পেতেন।

ভদ্রলোক বললেন, আমরা কোথায় যাব মার্টিন।

আমি বললাম,আংকেল,আমরা এখন যাব লং বীচ হোটেলে। সেখানে আপনাদের জন্য রুম বুক করে রেখেছি।আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে?

ভদ্রলোক বললেন,তুমি যেহেতু ঠিক করে রেখেছ।ভালো না হয়ে পারে?

আমি হাসলাম,লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের স্ত্রী কোন কথা বলছেন না।

ডাক্তার বাবুদের জন্য তিন তালায় রুম বুক করেছিলাম।তিনশ চার নাম্বার।সেখান থেকে সমুদ্রের দৃশ্য কিছুটা হলেও দেখা যায়।ডাক্তার বাবুর,পাচদিন থাকার কথা ছিল,কেন জানি দুই দিনের বেশী থাকবে না বললেন।। অথচ আমি বিশাল প্ল্যান করে রেখেছি।নাইক্ষংছড়ি, আলী কদম, মহেশ খালী, পাটুয়ারটেক সেন্ট মার্টিন । যেহেতু আমার কোন ইনভেস্টম্যান্ট নাই,মন খারাপ হলেও মেনে নিলাম।উনাদের সংগ দেবার জন্য, পাশের রুম তিনশ পাচ নাম্বার রুম টা নিজেই বুক করে ছিলাম।কেমন জানি ভদ্রলোকের কথায় অদ্ভদ মায়ার পরে গিয়েছিলাম।মনে হয় হিপনোটাইজ করে ফেলেছেন।করতে ও তো পারেন।ডাক্তারদের পক্ষে সব ই সম্ভব। কক্সবাজারের বিখ্যাত কোরাল মাছের ফ্রাই,আর রুপচাঁদার ফ্রাই সাথে ডাল, সাদা ভাত।। এই ছিল খাবারের আইটেমে।। আমি বাপু, বিষন খাবার রসিক।। যা পাই তাই খাই। বাছ বাছা বাছি নাই।কিন্ত লক্ষ্য করলাম,ভদ্রলোক তেমন কিছু একটা খাচ্ছে না। উনার স্ত্রীও শুধু রুপচাঁদা মাছ দিয়ে পুরো ভাত খেয়ে নিলেন। আমি বললাম,আংকেল খাবার কি পছন্দ হয় নি।
ভদ্রলোক হাসলেন, বলবেন,আমি একটু কমই খাই। কিন্ত তোমার আন্টির কিন্ত খুব পছন্দ হয়েছে।এই প্রথম পুরো কোন মাছ সে শেষ করেছে।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, বললেন, বাচ্চা ছেলেপেলেদের সাথে কি যে বল না তুমি?
এই প্রথম ভদ্র মহিলার কন্ঠস্বর শুনলাম। বয়স থাকলে, এই ভদ্রমহিলার কন্ঠ স্বরের প্রেমে পরে যেতাম।।
আমি বললাম,আন্টি,আরেক টা রুপচাঁদা এনে দেই।
দেখলাম,ভদ্র মহিলা কেমন জানি রাগ করল। আমার কথার উত্তর দিল না।কিছুটা বিব্রত হলাম।আমাকে কেন এভোয়েট করছেন উনি? আমি কি করলাম?

যত টুকু সম্ভব উনাদের কক্সবাজার ঘুরালাম।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।আমরা সূর্যাস্ত দেখে যখন হোটেলে আসলাম তখন রাত নয় টার বাজে।।রাতের খাবার খেয়ে যখন বিদায় নিতে যাব, ভদ্রলোক বললেন,ইয়াং ম্যান। এত তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে কি করবে?তোমার আন্টি ঘুমাবে।চল আমি আর তুমি সমুদ্রে যাই।আমি বললাম,এখন? মাত্র না আসলাম?

ভদ্রলোক হাসলেন, বললেন,এখন কে বলল? আমি যাব রাত বার টার পর।। নিস্তব্দ সমুদ্রের গর্জন শুনবো।পূর্নিমায় চাঁদ আর সমুদ্রের মিতালী দেখব।

আমি অবাক হলাম।কারন আজ যে পূর্নিমা সেটা আমার জানা ছিল না।ছ্যাকা খাওয়া মানুষ এই সমস্ত চাঁদ পূর্নিমা হিসাব আমাদের জন্য না।
আমি বললাম,কোন সমস্যা নেই।আপনি বললে,বান্দা হাজির হয়ে যাবে।

ভদ্রলোকের সাথে যখন বের হলাম, তখন ঠিক বারোটা ১২ বাজে।ভদ্রলোকের হাতে একটা ব্যাগ। আমার হাতে দিয়ে বললেন,দুই টা ওয়ান টাইম গ্লাস নাও।তখন বুঝতে পারলাম,ব্যাগে কি আছে।সাথে পানির বোতল।সমুদ্রে পাড়ে যেতে চার মিনিটের মত লাগে।।বিশাল বড় একটা চাঁদ।মনে হচ্ছিল সমুদ্র থেকে উদিত হচ্ছে।

ইয়াং ম্যান, এই গিফট টা তোমার জন্য।দেখলাম একটা ব্ল্যাক লেভেলের বোতল।। মনে মনে যা পরান খুশি হলাম।
ভদ্রলোক বললেন,এলকোহলের প্রতি কিন্তু আমার বিন্দু মাত্র আসক্তি নেই। আমি বললাম,তাহলে দুইটা গ্লাস আনতে বললেন যে।

ভদ্রলোক হাসলেন,ইয়াং ম্যান,আমি গ্লাসে করে পানি খাব।তোমায় সঙ্গ দিব।তুমি শুরু করতে পার।কত বছর পর এত সুন্দর চাঁদ দেখছি।ভদ্রলোক অপলক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে।
আমার নিজের লেখা একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল।
“আমি চেয়ে থাকি ওই, দূর আকাশের পানে,
যেখানে আকাশ মিশে গেছে বিস্তৃত রাশীতে “

বোতল টা খুলে দুই প্যাগ মারার পর বললাম,আচ্ছা,আংকেল,আপনি তো ডাক্তার মানুষ। মানুষ আত্নহত্যা কেন করে?

ভদ্রলোক চাঁদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,জানি না।
আমি বললাম,আপনি ডাক্তার মানুষ। আপনি না জানলে কিভাবে?

ভদ্রলোক,খুব শীতল কন্ঠে বললেন,তোমার ধারনা ভুল। গড অলমাইটি সব নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।মানুষ সব সময় যেমন দু:খে আত্ন হত্যা করে ঠিক তেমনি সুখেও আত্নহত্যা করতে চায়।

আমি হাসলাম বললাম,দূর, সুখে কে আত্নহত্যা করতে চায়।।

ভদ্রলোক বলল,একটা গল্প বলি, শুনবে?
যেহেতু দামী মদের বোতল গিফট করেছেন,উনার গল্প না শুনে কি উপায় আছে?
আমি বললাম,অবশ্যই।

ভদ্রলোক বললেন,আমি তখন সবে মাত্র মেডিকেল থেকে পাশ করে বের হয়েছি।ইংল্যান্ড থেকেও কিছু ডিগ্রী নিলাম। আফ্রিকাতেও প্রায় দশ টার মত দেশে ডাক্তার হিসেবে কাজ করলাম। কিন্ত বিশ্বাস কর, আমার না সব সময় দেশের প্রতি টান থাকত। মনে হতো,দেশের জন্য কিছু একটা করি।।তাই বিদেশের সেই উচ্চ জীবন আমাকে কখনো স্পর্শ করতে পারত না।একদিন স্বিধান্ত নিলাম,জীবনে যাই থাকুক না কেন দেশে ফিরে যাব।নিজ গ্রামে ক্লিনিক করব। বিনে পয়সায় নিজেদের লোকেদের সেবা করব। যেই ভাবা সেই কাজ।

কিন্ত আমার মোহ ভাংগতে বেশী দেরী হলো না।এখনকার লোকদের যতটুকু ভালাভোলা মনে করেছিলাম,তারা তেমন টা নয়। এমন কি নিজের ভাই বোনেরা ও আমার থেকে দূরে সরে গেল।আমি ভেবেছিলাম,নিজের বাবার সম্পত্তির উপর একটা হাসপাতাল দিব।কিন্ত আমার কথা শুনে ভাই বোনেরা রাজি হলেও, কিছু কুচক্রি মহলের গুটি চালাচালিতে সেটা আর হলো না।আমার ভাই বোনেরা চিন্তা করতে লাগল,আমি তাদের জমি সব নাকি নিজের নামে করে নিব হাসপাতাল দিয়ে।মার্টিন এর থেকে বড় কোন কষ্ট কি হতে পারে মার্টিন, তুমি বোঝ।

আমার এতক্ষনে, মাথা একটু জিম ধরা শুরু করেছে।আমি মাথা নাড়ালাম,বললাম,ঠিকিই বলছেন আংকেল?
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন,আমি তখন সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে পড়লাম। ভদ্রলোক বললেন,বাসা নিলাম এক কবির বাসার নিচে।তুমি কবির নাম বললে চিনে ফেলবে,তাই বলব না?বলেই ভদ্রলোক হাসলেন ।
আমি প্রতিউত্তরে হাসলাম,বললাম থাক না কিছু রহস্য?

ভদ্রলোক হাসলেন,বলবেন,আমার সন্তানদের উনি আর উনার স্ত্রীই কোলে পিঠে করে বড় করেছেন।
এবার আমার চোখ বড় হয়ে গেল।কিন্ত নিজের অবাকতা প্রকাশ করলাম না।
একদিন ব্র‍্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে আবেদের সাথে দেখা করতে গেলাম, উনাকেও আমার গরীবদের নিয়ে কাজ করার কথা জনালাম। ভদ্রলোক প্রচন্ড আমায়িক লোক।সব শুনে,বললেন,আপনি চালিয়ে যান।আমি আছি।কিন্ত কোন একটা কারনে উনিও পরে আর সাহায্য করতে অপারকতা প্রকাশ করেলেন।

আবার আমার আশা ভঙ্গ হলো।তবে আমি সৃষ্টি কর্তার উপর কখনো বিশ্বাস হারাই নি।জানতাম,আমার স্বপ্ন একদিন বাস্তব হবেই।ভাগ্যক্রমে, সেই কবির বাসায় আসত একজন খ্রীষ্টান ফাদার। একজন ইটালীয়ান ফাদার ছিলেন।একদিন উনি আমার নেম প্লেট দেখে, কবি সাহেব কে সাথে নিয়ে দেখা করতে আসলেন। জানালেন, মংলাতে উনার একটা হাসপাতাল আছে,আমি যেন সেটা দেখা শোনা করি। আমি চিনি না জানি না,বলে নাকি একজন ফাদার।হ্যা বা না বলব কিছুই বুঝতে পারছিনা।। তবে ফাদার নাছোড়বান্দা কোন ভাবেই আমার পিছু ছাড়লেন না।অবশেষে,আমি রাজী হই।একদিন সেই মংলাতে গিয়ে হাজির হই।কয়েক হাজার মানুষ সেদিন আমাকে ঢাল ঢোল পিটিয়ে বরন করে নিয়েছিল।কিন্ত এত এত লোকের মাঝে এক ষোড়শী কন্যার দিকে বার বার আমার চোখ আটকে যাচ্ছিল।বিশ্বাস কর,মার্টিন ওই রুপ আমি এখনো কারো মাঝে দেখেনি?ভদ্রলোকের ঠোটে চাপা একটা হাসি দেখতে পাচ্ছি।
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন,প্রতি দিন ১০০ থেকে ২০০ পর্যন্ত রোগী দেখা শুরু করলাম। মনে মনে ভাবতাম,সেই মেয়েটাও একদিন অসুস্থ হবে।নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবে।তারনাম, ঠিকানা বয়স, সব জানতে পারব।বুঝিলে মার্টিন ডাক্তার হবার এই সুবিধা।সব জানা যায়।
বলেই সেই বিখ্যাত হাসি।ওনার হাসিতে মুগ্ধতায় ভরা।সমুদ্রের টেঊ ও যেন সেই মুগদ্ধতায় সামিল হচ্ছে।

ভদ্রলোক বললেন,অবশেষে,আমার সেই অপেক্ষার প্রহর ফুরাল।একদিন মেয়েটা নিজেই একা একা আমার কাছে এসেছে,একদম একা।আমি প্রচন্ড ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।এখানে যত রোগী আসে, তাদের চোখে মুখে একটা ভয়,শ্রদ্ধা কাজ করে, কিন্ত এই মেয়ের মধ্যে তা কোন কিছুই লক্ষ্য করলাম না।।ভ্যাবাচেকা খেলেও সেটা তাকে বুঝতে দেই নি।সাধারন রোগীদের মত বললাম,নাম কি আপনার?
মেয়েটা খুব শীতল কন্ঠে বলল,পূর্নিমা।
আমি বললাম,পুরা নাম বলেন।মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,আমার কোন পুরা নাম নেই।
বয়স কত আপনার?
মেয়েটা বলল,মেয়েদের বয়স জানতে হয় না।আপনি আন্দাজ করে লিখে দিন।
এবার কিছুটা বিরক্ত হলাম,তারপর ও কিছু বললাম না,ডাক্তারদের এত সহজে বিরক্ত হতে নেই।
কি সমস্যা আপনার?
মেয়েটা কেমন জানি হাসি হাসলো,বলল,একটা ওয়ার্ড এর মানে বুঝি না,সেটা জানতে আসছি।

আমি এবার বললাম,ওয়ার্ডের মানে জানেন না ডিক্সেনারীতে খুজেন। আমার কাছে কি?
মেয়েটা বলল,শুনলাম আপনি ল্যাটিন পারেন, তাই। এখানে অন্য কেউ ল্যাটিন পারে না। তাই আপনার কাছে আসলাম।।
আমি বললাম,কি শব্দ।।আর আমি তত টাও ল্যাটিন জানি না।

মেয়েটা বলল,দুই ওয়ার্ড।
আমি বললাম,কি?
মেয়েটা বলল, তি আমো?

এই প্রথম আমি কার কাছ থেকে এত বড় ধাক্কা খেলাম।আমার বিশ্বাস ই হচ্ছিল না এমন কিছু একটা হতে পারে।।আমি যারে চাই,সেও আমারে চায়।এটা কি সম্ভব?
কথাটা বলে মেয়েটা আর থাকেনি সেখানে।।শুধু এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে ভো দৌড়।।তার চলে যাওয়া, শেষ বারের মত ফিরে তাকানো,মুগ্ধতা ছড়ানো হাসি।আমি তোমাকে সেই অনুভূতি কখনো ভাষায় প্রকাশ করা করতে পারব না।এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।তবে আমার সেই স্বর্গীয় অনুভূতি বেশী ক্ষন স্থায়ী হয় নি।।সকাল বেলা মুগ্ধতা ছড়ানো হাসি দেখার পর, বিকালে চিঠি পেলাম বাড়ি থেকে।। চিঠির সারাংশ ছিল মা খুব অসুস্থ।তাকে দেখতে যেতে হবে।সাধারনত এই সমস্ত চিঠি পেলে কোন ছেলেই ঠিক থাকতে পারে না।আমি ওই রাতেই, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।।তবে, যতটা না মা অসুস্থ ভেবেছিলাম ততটা অসুস্থ মা ছিল না।সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে,আমার জন্য পাত্রী দেখা হয়েছে।।বাড়িতে গিয়েই দেখি,সেই পাত্রী বাড়িতেই বসে আছে।।মা বললেন,তুই ডাক্তার মানুষ,কোথায় থাকিস না থাকিস আমার চিন্তা হয়।এই মেয়ে তোর জন্য দেখে রেখেছি,আন্টি পরিয়ে যেখানে ইচ্ছা চলে যা।।এই ভাবে কি কোন বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রথম ধাপ চলতে পারে আমার জানা ছিল না। সব কিছু এতটাই তড়িৎ গতিতে ঘটে গেলো,আমি বুঝার আগেই আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো।যার সাথে এনগেজমেন্ট হলো, একে অপন্সরীদের সাথে তুলনা করলেও কম হবে।। হাজার হাজার বছর ধরে হাজার হাজার লেখক এই রুপের বর্ননা দেওয়ার চেস্টা করেছে,কিন্ত কোন শব্দই এই রুপের বর্ননা দিতে পারে নি।

আমার মন পরেছিল মংলার সেই পশুর নদীর পারে।পূর্নিমার জন্য।। যে মেয়েকেই দেখি কেন জানি মনে হয় এই মেয়েই পূর্নিমা।।।।বাড়িতে তিন দিন থাকার পর মংলা আবার বেক করলাম। যেদিন বেক করলাম সেই দিনের প্রথম রোগীই ছিল পূর্নিমা।।মেয়েটার চোখের দিকে কেন জানি তাকাতে পারছিলাম না।বড় একটা অপরাধ করে এসেছি।পরিবারের কথায়,পরিবারের সুখের দিকে তাকিয়ে এই ভুল সমস্ত ছেলেরাই করে থাকে।
আমি অচেনা একজনের মত জিজ্ঞেস করলাম,নাম কি আপনার?

কচু পাতায় জলের কয়েক ফোটা যেমন নি:শব্দে পরে যায়,লক্ষ্য করলাম মেয়েটার চোখ দিয়ে ঠিক সেই ভাবেই পানি গড়িয়ে পরল।আমি তাকাতে পারছিলাম না।নিজের অজান্তেই কেন জানি মনে হচ্ছিল, আমি পাপ করেছি।মারাত্নক রকমের পাপ।ভালোবেসেছি একজন কে, আর বিয়ে আরেক জন কে।এর থেকে বড় পাপ আর কিছুই হতে পারে না।।
আমি ভাংগা ভাংগা গলায় বললাম,আপনার সমস্যা কি?

মেয়েটা নিজেকে সংবোরন করল,বলল,একজন গত তিন দিন ৬ ঘন্টা ৪৫ মিনিট কোন কিছু না বলে আমার থেকে দূরে সরে আছে।।সে জানে যে, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারব না।তারপর সে কেন এই রকম করে।।

আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলাম।আমার যাবার প্রতিটি মূহুর্তে সে আমাকে মিস করেছে।প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে সে আমাকে অনুভব করেছে।মার্টিন, তুমি আমাকে যে প্রশ্ন আজকে করলে সে প্রশ্ন সেও আমাকে ওইদিন করেছিল।মানুষ কেন আত্নহত্যা করে,সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজো দিতে পারি নি।
মেয়েটা ভাংগা ভাংগা কন্ঠে বলল,আজ আমি পশুর নদীর পারে থাকব। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে।রোগী দেখা শেষ হলে, কারো যদি ইচ্ছে হয় যেন সে আসে।আর ইচ্ছে না হলে,মানুষ কেন আত্নহত্যা করে,সে সেটা জানতে পারবে?মার্টিন আমি আমার জীবনে একবারই মদ্যপান করেছিলাম।সেটা ছিল সেদিন। এর পর থেকে কখনো কোন অবস্থাতেই আমি মদ্যপান করেনি।প্রতিজ্ঞা করেছি।আমি প্রচন্ড হতাশা গ্রন্থ হয়ে পরেছিলাম।একদিকে এনগেজমেন্ট করা মেয়ে,অন্য দিকে ভালোবাসার মানুষ।আমাদের সময় এনগেজমেন্ট করা মানে অর্ধেক বিয়ে, কোন কারনে এনগেজমেন্ট ভেংগে গেলে মেয়েটা আর তার পরিবারের চরম সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মাঝে দিয়ে যেতে হয়। মানুষ কেন আত্নহত্যা করে তখন বুঝা যায়।আবার একটা মেয়ে,নিজের সব কিছু দিয়ে একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে,যে ভালোবাসা পবিত্র আত্নার পবিত্রতাতে পরিপূর্ণ সেটাকে প্রত্যাখ্যান করাও যায়। চরম স্বীধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।কি করব, বুঝতে পারছিলাম না।ফাদারকে বলে সেই দিনের মত ছুটি নিয়ে নিলাম।ঘরে এসে ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য মদকেই বেছে নিলাম।সেই দিন ই প্রথম ছিল।।

আমার যখন ঘুম ভাংগে, তখন ফাদার বার বার আমার ঘরে নক করছে।শুধু ফাদার না,আরো বিশ ত্রিশ জন। মনে হচ্ছে,ঘর ভেংগে ফেলবে।।কোন রকমে উঠলাম। নেশাটা তখনো পুরোপুরি কাটেনী।ঘুম ঘুম ভাব কাজ করছে।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দশ টা বাজে। মানে তিন ঘন্টা দেরী হয়ে গেছে।মেয়েটা এখনো কি নদীর পারে অপেক্ষা করছে? কি করছে ও? ফাদার কেন এত বার নক করছে,এই রকম হাজারো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে দরজা খুললাম।

ফাদার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,খুব খারাপ একটা ঘটনা ঘটে গেছে।একটা মেয়ে আট নয় জন দ্বারা রেপড হয়েছে।অবস্থা খুবই খারাপ।এখনই কিছু না করলে বাচানো যাবে না।।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পরল।আমি মনে মনে, সৃষ্টকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিলাম,হে ইশ্বর এ যেন ও না হয়।

মেয়েটার বাবা মা কাদছে।মেয়েটার ছোট বোন টাও কাদছে।আমি প্রায় উন্মাদের মত অপারেশন থিয়েটার এ পৌছাই। রক্তাক্ত একটা দেহ পরে আছে,সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা শুনে নি।পুর্নিমা, আমার পূর্নিমা।। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি করব।। মার্টিন, আমি ডাক্তার, কখনো কোন অপারেশন করতে গিয়ে আমার হাত কাপে নি।। আমার বাবার অপারেশন যখন করেছি,তখন ও হাত কাপেনি।।কিন্ত এই প্রথম আমার হাত কেপে উঠেছিল।পুর্নিমার শরীরে অস্ত্র ঠেকাতে বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছিল।চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।।নিজেকে সংবোরন করতে পারছিলাম না।।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরের আওয়াজ গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।ফাদার,বার বার বলছে,এত রাতে মেয়েটা নদীর পার একা একা কি করছিল?
মেয়েটার মা,কাদো কাদো কন্ঠে বলছে,আমরা কিছু জানি না ফাদার।কিছু জানি না।

কথাগুলো শুনছি,আর ঢুকরে ঢুকরে কেদে উঠছি।অপারেশনে যে সিষ্টার ছিল,সেও কেন জানি কাদছে।কি বড় পাপ করেছি,আমি।এর থেকে বড় পাপ আর কি হতে পারে।আমি যদি মদ না খেয়ে সেখানে যেতাম তাহলে এই কাজ কখনো হতো না।রক্ত পরা যখন বন্ধ হলো,আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম,দেখলাম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আছে।।চোখের এক কোনা দিয়ে দু ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পরছে। শুধু জরানো কন্ঠে বলল,তি আমো।।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।বাচ্চা ছেলেদের মত ঢুকরে ঢুকরে কেদে উঠলাম। দ্রুত অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে গেলাম।রাত তখন বারোটা । আমি পশুর নদীর পারে।চিৎকার করে কাদছি।কি করেছি আমি।।এর ভিতর আবার মার চিঠি এসেছে,মা অপারেশন থিয়েটার, ভালো অবস্থায় নেই।আমার বিয়েটা দেখে যেতে চাচ্ছে,এই মেয়ের সাথে।।আমি কি করব? প্রচন্ড, কান্নায় আমার পশুর নদীর দু পাড় আন্দোলিত হচ্ছে।।এক সময় আমি উঠে দাড়াই।।কোন একটা কঠিন স্বীধান্ত নেই আমি।। কোন কঠিন স্বীধান্ত নিলে ছেলেদের চোখ অকারণে ভিজে যায়।

আমার এত ক্ষন যা নেশা ছিল পুরাটাই কেটে গেছে।আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছিলাম।বললাম, আংকেল,আপনি কি করেছিলেন,মৃত্য শয্যার মার কথা শুনেছিলেন নাকি পূর্নিমার ভালোবাসার কাছে ফিরে গিয়েছিলেন।

ভদ্রলোক, আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। উনার সেই বিখ্যাত হাসি।যে হাসির মুগ্ধতা সাগরের ঢেউয়ের সাথে মিশে মিশে চন্দ্রে গিয়ে পৌছেছে।।

One thought on “চাঁদের আলোয় আমি ,আপনি আর সে……জেরী মার্টিন গমেজ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *