আমি ছোট বেলা থেকেই বই পড়তে প্রচন্ড ভালোবাসি।এখনো প্রতি মাসে কোন না কোন বই অর্ডার করি।কাজের চাপে আগের মত পড়া হয় না।তবে,আমি যেহেতু ভাওয়ালের তাই, ভাওয়ালের প্রতি আমার বিশেষ অনুভূতি আছে।।আমার অনেক লেখায় ভাওয়াল তথা নাগরী জনপদে খ্রীষ্টানদের জন্ম এবং বেড়ে উঠার কথা উল্লেখ্য করেছি।আমার ওয়েব সাইট গুলোতে রেখে দিয়েছি সযত্নে।আগ্রহী গন পড়তে চাইলে,পড়ে দেখতে পারেন।যাই হোক,মূল আলোচনায় আসি।।
বাংলা সাহিত্যে যে তিনটি গ্রন্থ অমর হয়ে রয়েছে,সেই সাহিত্য তিনটি নাগরী থেকেই রচিত। হয়ত বা বেশীর ভাগ জার্নাল বা ব্লগে নাগরী শব্দ টা লেখা হয় না,কিন্ত ইতিহাস কে অস্বীকার করাও যায় না।ব্রাহ্মণ – রোমান ক্যাথলিক সংবাদ, কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ,এবং বাঙ্গলা ব্যাকরণ ও তৎসহ বাঙ্গালা- পর্তুগীজ শব্দকোষ এই তিনটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল এই নাগরী থেকে।।এই তিনটি বই কিন্ত বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় গ্রন্থ।হয়ত, অনেকে বুঝতেই পারছেন না কি পরিমান মূল্যবান এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যর জন্য।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস খুজতে গেলে আপনি কখনোই এই তিনটি গ্রন্থ কে বাদ দিতে পারবেন না।প্রথম বইটির লেখক,এক জন রাজপুত্রের। যার না ছিল দোম অন্তনীও ডি রোজারিও।উনার বিষয়ে বিশাল একটি আর্টিকেল লেখা আছে,আমার ওয়েব সাইটে,চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।
আজকে উনার সৃষ্ট গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব। আর বাকী দুইটার রচয়িতা ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও।সেন্ট নিকোলাস চার্চে বসে যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।
১৯১১ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে, কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হস্টেন এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে এই বই তিনটির তথ্য উনার দেন।আগে কেউই এই গ্রন্থ গুলোর খবর আমাদের দিতে পারেনি।এই তিনটি গ্রন্থের আগে অনেকে অনেকের নাম বলেছেন।উদাহারন স্বরুপ বলা যেতে পারে,ন্যাথায়েল ব্রাসি হলডেটের কথা।উনার গ্রন্থ, যা বাংলা ব্যাকরন নিয়ে লেখা সেটিকে ড.দীনেস চন্দ্র সেন ইউরোপীয় দের প্রথম গ্রন্থ বলে দেখান। আসলে এর আগেই ম্যানুয়াল দা আসসুম্পাসাও তার গ্রন্থ লেখে শেষ করেছিলেন।। সিলোগ নামে একটি গ্রন্থে বাংলা ভাষায় রচিত একটি গান কে বাংলাভাষায় ইউরোপীয়দের লেখা প্রথম বাংলা ভাষায় রচিত উল্লেখ্য করা হলেও পরে জানা যায় সেটা আসলে বাংলা না।মালয় ভাষা।১৯১১ সালে সেই ভুল সবার ভাংগে।১৯১১ সালে ফাদার হস্টেন সবার ভুল ভেংগে প্রমান করেন যে,ইউরোপীয়দের হাতে প্রথম রচিত বাংলা গ্রন্থ আর কোথাও না,নাগরীতে বসেই রচিত হয়েছিল।১৯১৪ সালে ফাদার তা সুধী সমাজে পরিবেশন করেন। এবং তা পরবর্তীতে কোলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় ও পুনে রঞ্জন পাবলিশিং হাউজ হতে মুদ্রিত হয়।
এখানে বসেই লেখা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অনেক নিদর্শন।।
১৭৪৩ সালে ব্রাহ্মণ রোমান -ক্যাথলিক সংবাদ ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও সম্পাদনা করেছিলেন।যার লেখক ছিলেন,ভাওয়াল অঞ্চলে খ্রীষ্টান সমাজ গড়ে উঠার প্রথম কারিগর দোম অন্তনী ডি রোজারিও।। এটি মূলত খ্রীষ্ট ধর্ম কে প্রচারের জন্য লেখা হয়েছিল।এটি কে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা না করে,সাহিত্য বিবেচনায় বেশী সমাদৃত করা উচিত। দোম অন্তনী ছিলেন ভূষানার রাজপুত্র। পর্তুগীজ জলদস্যরা উনাকে অপহরন করে,এবং ম্যানুয়েল ডি রোজারিও নামের একজন খ্রীষ্টান যাজকের কাছে বিক্রি করে দেন। উনাকে নিয়ে লেখা বিস্তারিত কমেন্ট বক্সে দিয়ে দিচ্ছি বিধায় আর বললাম না।ব্রাহ্মণ – ক্যাথলিক সংবাদ মূলত একটি কথোপকথন গ্রন্থ যা হিন্দু ধর্মকে অসার প্রমান করে,খ্রীষ্ট ধর্মের গুনগান করা হয়েছে।এই বইয়ের পান্ডুলিপি ফাদার ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও পর্তুগালের এভোরোর আর্চ বিশপের গ্রন্থালয়ে দান করেছিলেন বলে ধারনা করা হয়ে থাকে।ফাদার আসসুম্পাসাও সেটার পর্তুগীজ অনুবাদ ও করেন।দোম আন্তনীও প্রথম বাংগালী খ্রীষ্টান যার গ্রন্থ বিদেশী ভাষায় অনুবাদিত হয়েছিল।আর যার জন্ম হয়েছিল নাগরীতে।।
কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ ফাদার ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও ১৭৩৫ সালে রচিত, যার উৎসই ছিল নাগরী।যা ১৭৪৩ সালে লিসবনে, ফ্রান্সিস দা সিলভা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল।বইটির তিনটি কপির সন্ধান পাওয়া যায়।একটি পর্তুগালের এভোরাতে, আরেকটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে আরেক টি নাম পত্র বিহীন অবস্থায় পাওয়া যায়।১৮৩৬ সালে চন্দন নগরের ফরাসী পাদ্রী গুয়ারিন পরিবর্ধিত সংস্করন হিসেবে বের করেন শ্রীরাম পুর হইতে।এই গ্রন্থ যে,ভাওয়ালের নাগরীতে বসে লেখা হয়েছিল,তার প্রমান ১৭৫০ সালের ২৫ শে নভেম্বরের ফাদার ফ্রে এমব্রোসিও নামের নামের একজনের চিঠি।যিনি বলেছিলেন এই গ্রন্থ যখন লেখা শুরু হয় তখন ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও ভাওয়ালেই ছিলেন।।তবে এই গ্রন্থ ভাওয়াল অঞ্চলে বসে লেখা শুরু হলেও এর শেষ কিন্ত ভাওয়ালে হয় নি।ফাদার ম্যানুয়েল ১৭৩৪ সালে নাগরীর সেন্ট নিকোলাস টিলেন্টুর পরিচালক ছিলেন।১৭৩৪ সালের ২৮ আগষ্টের পূর্বেই ধারনা করা হয় কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ লিখিত হয়ে যায়।।কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ উৎসর্গ করা হয়েছিল,এভোরার আর্চ বিশপ মিগেল দা তাভোরাকে।এই গ্রন্থটি কোলকাতায় পাওয়া যায় ১৮৪৫ সালের ৩ রা মার্চ এগোনেস নামের একজনের কাছ থেকে।যার মধ্যে ৩৩ থেকে ৪৮ পৃষ্ঠা, ১৫৫ হতে ১৫৮ পৃষ্ঠা,৩২১ হতে ৩৩৬ আর ৩৭১ আর ৩৭২ পৃষ্ঠা পাওয়া যায় নি।মূল গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখা ছিল ৩৯১। এই গ্রন্থটি মূলত গুরু শিষ্যের কথোপকথন।এই গ্রন্থটির প্রথম সংস্করনের প্রায় ১০০ বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এই বইটি মূলত ফাদারদের জন্য লেখা হয়,যারা বাংলায় ধর্ম প্রচারে আসতো,তাদের সুবিধার জন্য।কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ দুই ভাগে বিভক্ত।প্রথম ভাগে নীতির বিশদ ব্যাখ্যা অন্য ভাগে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রার্থনা।
বাঙ্গলা ও পর্তুগীজ ভাষায় শব্দকোষ ও ব্যাকরন নামের বইটিও ধারনা করা হয় নাগরীতে বসেই লেখা হয়। কারন ফাদার ম্যানুয়েল যে সময়ে বইটি শেষ করেন, তখন তিনি ভাওয়ালেই ছিলেন।১৭৪৩ সালে এই বইটি এভোরার আর্চ বিশপ ডি মিগলকে উৎসগ করা হয়,এবং ফ্রান্সিস্কো দা সিলভা তা প্রকাশ করেন। এটি রোমান হরফে লেখা একটি গ্রন্থ।এই গ্রন্থটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেড় টার মত আছে।একটি সম্পুর্ন আরেক টি খন্ডিত।এই গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬০২। প্রথম দশ পৃষ্ঠা ভূমিকা।পরের ১ থেকে ৫৯২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যাকরন ও শব্দকোষ। এই বইটি নিয়ে বিতর্ক আছে।অনেকে ধারনা করেন এই গ্রন্থটি ম্যানুয়েল দা আসসুম্পাসাও রচিত নয়।কারন ১৬শ, ১৭ শ শতাব্দীতে বাংলায় চারটি সম্প্রদায় বাংলায় বানী প্রচার করেছেন।কয়েক জন ফাদারের নাম উল্লেখ্য করা যায়,যেমন ফ্রান্সিকো ফার্ন্দাদেজ,ডোমিনিকা গো দা সুজা,মেইকইর দা ফনস্কো,আদ্রো বোভে,ফাদার গস্পার ডা,ফাদার আসসুম্পাসাও, ফাদার পেরেরা,ফাদার ফিগুরেডা। উনারা প্রত্যেকেই বাংলায় ধর্ম প্রচার করেছিলেন।তাই তারা বাংলা শিখার জন্য হলেও শব্দকোষ গুলো শিখেছিলেন।তাই ধারনা করা হয়,উক্ত গ্রন্থটি ফাদায় আসসুম্পাসাও এর না ও হতে পারে।তবে সেটা অনুমান মাত্র।এমনটা নাও হতে পারে।
যাই হোক না কেন,যেভাবেই হোক না কেন?নাগরী নামটি কিন্ত জড়িয়ে আছে ওতোপ্রোতো ভাবেই।