গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের নাগরী মিশনের অন্তগর্ত বাগদী গ্রামের এক শিকারী, যার মাধ্যমে রাজশাহী তথা উত্তর অঞ্চলের খ্রীষ্টধর্মের বীজ বপন হয়েছিল, আজ তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আজকের লেখা।পল গমেজ শিকার যার নেশা ছিল। আমার যত দূর মনে হয়, উনার লেখা কোন শিকারের বই, কোন এককালে পড়েছিলাম।আমার ভুলও হতে পারি।শিকার নিয়ে বইটা লেখা হয়েছিল।যাই হোক পল গমেজ শিকার করতে ভালোবাসতেন। এক সময় সেই শিকারীই উনার পদবী হয়ে গেল।পল গমেজ হয়ে গেল পলু শিকারী।আঠারশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং উনিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ততকালীন ঢাকা জেলার রাঙ্গামাটিয়া গ্রাম থেকে একদল ব্যাপিষ্ট পালক এই অঞ্চলে বানী প্রচার করতে আসতো।এখানে উল্লেখ্য যে, কিছু সংখ্যক মানুষ খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত ছিল। তাদের দেখাশোনা করার জন্য এই পালক গন মূলত আসত এই রাজশাহী অঞ্চলে।সু প্রাচীন এই বরেন্দ্র অঞ্চলে। এমনিতেই বরেন্দ্র বনাঞ্চলের জন্য বিখ্যাত ছিল।বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী পুন্ড্র নগর আর বরেন্দ্র একই অঞ্চল। পুন্ড্র অঞ্চল নিয়ে একটি পৌরানিক কাহিনী প্রচলিত ছিল।সেখানে বলা হয়েছে যে,মহাভারতের দৈত্যরাজ বলীর পত্নী সুদেষ্টার গর্ভে পাচ জন পুত্র সন্তান জন্মায়। অঙ্গ, বঙ্গ,কলিঙ্গ,ওড্র,আর পুন্ড্র। আর সেই পুন্ড্রের নামেই নাম করন করা হয় পুন্ড্র নগরের। আর এই পুন্ড্র নগরের বরেন্দ্র নামের এক ক্ষত্রীয় দখল করে তার নাম দেন বরেন্দ্র।আর এই বরেন্দ্রের অংশ ছিল রাজশাহী।যাই হোক মূল আলোচনায় আসি।।

এই অঞ্চল এতটাই ঘন জংগলে ঘেরা ছিল যে,এখানে বন্যশুকর থেকে শুরু করে বাঘ পর্যন্ত পাওয়া যেত।বিশেষ করে বন্য শুকরের অত্যচারে এই অঞ্চলের মানুষ অতিষ্ট ছিল।একবার এক পালক, এই বন্য শুকরের যন্ত্রনায় তার ভক্তদের জানিয়ে দেন যে,তারা যদি বন্যশুকরের ব্যাপারে কোন বিহিত না করে,তাহলে তিনি আর এই অঞ্চলের বানী প্রচার এবং পালকীয় কাজে আসবেন না।এই অঞ্চলের বন্য শুকর এত টাই হিংস্র ছিল যে,কেউ এই শুকর মারার ব্যাপারে সাহস করল না। তখন সেই পালকের এক বাবুর্চী, জানান যে,এই শুকরের ব্যাপারে এই জনই বিহিত করতে পারে, যিনি কিনা কালীগঞ্জের নাগরী মিশনের বাগদী গ্রামের বাসিন্দা পল গমেজ। ওরফে পলু শিকারী।। পলু শিকারীকে যখন এই প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব লুফে নেন। খুব সম্ভবত ১৯১৮ থেকে ২০ সালের মধ্যে রেলগাড়ীতে চড়ে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে বর্তমান চাটমোহরে উনি নেমেছিলেন।। রাজশাহী ধর্ম প্রদেশের প্রায় প্রতিটা ধর্মপল্লীতে উনি শিকার করেছেন।জোনাইল,বর্নী,বনপাড়া,মানগাছা।এই সমস্ত এলাকা ছাড়াও আরো অনেক জায়গায়। এই অঞ্চল গুলো এতটাই সুন্দর এবং শিকারের জন্য উপযুক্ত ছিল যে,পলু শিকারী চিন্তা করলেন যে,এই অঞ্চলেই তিনি বসত বাড়ি স্থাপন করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ।।

১৯২১ সালে, পলু শিকারী স্ত্রী, সন্তান নিয়ে চাটমহরে এসে পৌছান।মথরাপুর গ্রামে তিনি বসতি স্থাপন করেন। তার এই বাড়ির নাম বর্তমানে মালদালা নামে পরিচিত। এই জায়গায় তিনি একটি স্কুল ও স্থাপন করেছিলেন। পলু শিকারী এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করতেনা বলেই আমার মনে হচ্ছে।কারন উনি উনার জীবনে বসতি অনেক বার পরিবর্তন করেছিলেন।মথুরাপুর থেকে উনি বসত করেন লাউতিয়া গ্রামে, তারপর সেখান থেকে যান মনগাছা গ্রামে। সেখান থেকে যান কাথুলী নামক এক গ্রামে। আমি রাজশাহী অঞ্চলে কখনো যাই নি,তাই হয়ত নাম গুলো ভুলও হতে পারে।ইন্টার নেট, বই থেকে সংগ্রহ এবং ইংরেজী থেকে বাংলা করায় ভুল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। বিশেষ করে নামের বানানে।যাই হোক এই কাথুলী গ্রামে ১৯৪৫ সালে উনি স্থায়ী ভাবে বসত বাড়ি স্থাপন করেন।

একবার এখান কার এক জমিদার ঘোষনা করল,যে কেউ একটি বন্য শুকরের লেজ দিতে পারবে উনি তাকে এক বিঘা জমি দান করবেন। পলু শিকারী তখন সেই জমিদারকে লেজ উপহার দিলে, জমিদার তখন তাকে এক বিঘা জমি দান করেন। পলু শিকারী,তার ভাই ডেঙ্গুয়া গমেজ,নাগর রোজারিও এবং নাম না জানা অনেকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে।ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে খ্রীষ্টানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নাগরী,রাঙ্গামাটিয়া,তুমিলিয়া, দড়িপাড়া, সাভার,হারবাইদ, পাগর থেকে দলে দলে লোক এসে ১৯২৫ থেকে ২৬ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে মোটামুটি এই ছোট খাট খ্রীষ্টান পল্লী বানিয়ে ফেলে।। তবে বন্য প্রানীর অত্যাচার আর স্থানীয়দের খ্রীষ্টানদের প্রতি ঘৃনা দিনকে দিন বেড়েই চলছিল।নাগর রোজারীও, যিনি পলু শিকারীর সঙ্গী ছিলেন তার প্রায় ১৬ হাতের মত ঘর স্থানীয় রা পুড়িয়ে দিয়েছিল।এত সব অত্যাচার সহ্য করতে না পেড়ে এবং খ্রীষ্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে পলু শিকারী মনে করলেন যে,এখানে ধর্মপল্লী এবং পালকীয় সেবার দরকার আছে।তাই তিনি ঢাকার বিশপের বরাবর চিঠি লিখেন। কিন্ত সেই চিঠির কোন উত্তর আসে নি। তিনি ধৈর্য্য হারা না হয়ে আবার চিঠি লিখেন। অবশেষে ঢাকার বিশপ ফাদার জে কে ক্রাউলিকে পাঠান।এবং ফাদার পলু শিকারীর সাথে দেখা করেন। ফাদার বললেন যে,উনার প্রার্থনা ঘর তৈরীর জন্য এক খন্ড জমি দরকার।। পলু শিকারী তখন সেই জংলী শুকরের লেজের বিনিময়ে পাওয়া জমি টুকু দান করে দেন ফাদার কে।আর এই ভাবেই পলু শিকারী রাজশাহী অঞ্চলের খ্রীষ্টানদের গোড়াপত্তন স্থাপন করেন।

♨️ কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১.ফাদার আলবার্ট টমাস রোজারিও-বাংলাদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও ইতিহাস।

২.ফাদার দিলীপ এস কস্তা – বাংলাদেশের খ্রীষ্টমন্ডলী পরিচিতি।

৩.লুইস প্রভাত সরকার-

বঙ্গদেশে খ্রীষ্ট ধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়।

৪.নগেন্দ্র কে আর সিং- বাংলাদেশের এনসাইক্লোপিডিয়া

৫.রমেশ চন্দ্র মজুমদার – বাংলার ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *