আপনি কি, অশোক এর নাম শুনেছেন।বলিউডে বিখ্যাত এক অভিনেতা শাহরুখ খান এই নামে একটা সিনেমা করেছেন।বাংলায় সেটার নাম করলে দাঁড়ায় আশোকা। কারিনা কাপুর ও ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন।খুবই উচ্চ মানের, একটা ছবি।কিন্ত বেশী একটা সাড়া ফেলতে পারেনি এই সিনেমা।মানুষ অশোক নামের কাউকে এখন আর মনে রাখে না।এই প্রজন্মের কয়জন ছেলেমেয়ে অশোকের নাম মনে রাখছে বলেন। আর রাখবেই কেন, উনার নামে না আছে কোন মহা সড়কের নাম, বিশ্ববিদ্যালয় না আছে কোন গ্রন্থাগার। কিছুই নেই।খ্রীষ্ট পূর্ব ৩০৪ অব্দে পাটালীপুত্র, বর্তমান বিহারে জন্মগ্রহন করেন উনি।ধারনা করা হয় উনি ছিলেন মগধ অঞ্চলের রাজা।আর মগধ অঞ্চলে এই বাংলাদেশেও ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০ কিংবা ৬১ তে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, যুদ্ধের নাম ছিল ছিল কলিঙ্গার যুদ্ধ।এই যুদ্ধ এত টাই ভয়ংকর ছিল যে ওই সময়ে প্রায় এক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। সম্রাট অশোক এই ক্ষয় ক্ষতি দেখে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। নিজের ছেল কে শ্রীলংকা তে পাঠান বৌদ্ধ ধর্ম বানী শিখার জন্য।এটা আহামরী কোন কাহিনী না ও হতে পারে।প্রাচীন বাংলায় উনার হাত ধরে এসেছে, শান্তি স্থাপন হয়েছে,এটা কি গর্বের বিষয় নয়।আমি ড.মোহাম্মদ ইউনুস কে যথেষ্ট সম্মান করি,উনি আমাদের গর্ব। একমাত্র নোবেল জয়ী।কিন্ত উনার প্রতিষ্টান গ্রামীন ব্যাংক নোবেল পুরুষ্কার পেয়েছেন শান্তিতে।আমার কাছে হাস্য কর লাগে।যে গ্রামীন ব্যাংক মৃতের টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত লাশ কবর দিয়ে দেয় না,কিস্তির টাকা পরিশোধ না করতে পারলে গরীবের ঘরের চাল খুলে নেয়,ছাগল বিক্রি করে দেওয়ার মত অসংখ্য ঘটনা আছে,আর এই ঘটনা গুলোর মাধ্যমে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে আমি জানি না।সে ক্ষেত্রে সম্রাট অশোক তো বর্বর যুগের মানুষ হয়েও শান্তির জন্য কাজ করে গেছেন।
আচ্ছা, বাদ দেন অশোকের কথা।আরেক দিন বলা যাবে অশোকের কথা।আপনি কি শশাংকের নাম শুনেছেন।এই যে আপনি বৈশাখী মেলায় শাড়ী পড়ে,ঘুরেন, পাজ্ঞাবী পড়েন এই বৈশাখী মেলা মানে পহেলা বৈশাখের জন্য কিন্ত আপনার সম্রাট শশাংক কে ধন্যবাদ দিতে হবে।এই লোকের জন্য আপনি পেয়েছেন বাংলা ক্যালেন্ডার। উনার এলাকা ও ছিল প্রাচীন বাংলার অন্তর্ভুক্ত। কিন্ত আমাদের বই গুলোতে বলা হল কে বাংলা সাল প্রচলন করেছেন, সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবর যদি প্রচলন করে তাহলে আজ বাংলা সাল হত কত ৪৭৩ বা ৭৪ এর মত। কিন্ত আজ বাংলা সাল কত ১৫ ই শ্রাবন ১৪২৮। কোথাকার কোন আকবর, খুনি লুটতরাজ চেঙ্গিস খান, তৈমুরদের বংশধর লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা কারী দানব দের আমরা শ্রদ্ধ ভরে স্মরন করি কিন্ত এরা কেউ বাংগালী ছিল না।বাইরের দেশ থেকে এসে শাসন করেছে।কিন্ত এই উপমহাদেশে মুঘলদের নামে কয়েক শ স্থাপনা আছে,শশাংক কিংবা অশোক দের নামে কিছু নেই।যাই হোক,এদের মত এমন ই এক হতভাগ্য বাংগালী হল। সর্বকালের সেরা বাংগালীর তালিকায় উনি ছিলেন ১৮ নাম্বারে।লক ডাউনের সময় বাড়ি থেকে অনেক দূরে যখন একা একা অবস্থান করছি,তখন মনে হল বই পড়ি। সময় কেটে যাবে।আর আমাদের বই পড়ুয়াদের কয়েক জনের গ্রুপ আছে যেখানে আমরা প্রতি মাসে তৃতীয় রবিবার মিলিত হয়ে বই বিষয়ক আলোচনা করি।আমার থেকে সবাই ই অনেক উচু লেভেলের পাঠক। উনাদের সাথে কথা বলতে গেলে অনেক হিসেব করে কথা বলতে হয়। তাই চিন্তা করলাম বই পড়ে তারপর আলাপ করব।এখন যে বইটা পড়ে শেষ করলাম সেটার নাম “নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা”. অসাধারন একটা উপন্যাস।অতীশ দিপংকর কে নিয়ে জীবন ভিত্তিক উপন্যাস।
অতীশ দিপংকর, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে,পালযুগে মগধদের পুর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশের অঙ্গদেশের পুর্ব প্রান্তের সামন্ত রাজ্যের সাহোর, যা ভাগল পুর নামে পরিচিত, তার রাজধানী বিক্রম পুরের সামন্ত রাজা কল্যান শ্রী এবং প্রভাবতী দেবীর গর্ভে ৯৮২ সালে জন্ম গ্রহন করেন। উনার জন্মস্থান ধরা হয়ে থাকে, বিক্রম পুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। ছোট বেলার নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ।তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি।১০ বছর বয়সে বৌদ্ধ ধর্মের শাস্ত্রের অনেক জ্ঞান তিনি লাভ করেছিলেন।এই বয়সেই তিনি সংস্কৃত এর মত ভাষা শিখে গিয়েছিলেন তিনি।উনার গুরু বৌদ্ধ পন্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী ১২ বছর বয়সে বোধিভদ্রের কাছে দীক্ষা নেন। বোধিভদ্র ছিলেন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য।নালান্দা নিয়ে আগে লেখেছি।কারো প্রয়োজন হলে নক দিলে লিংক দিতে পারব।যাই হোক ১৮ বছর পর্যন্ত উনি বোধিভদ্রের কাছ থেকে শিক্ষা নেন।১৮ থেকে ২১ পর্যন্ত উনি পন্ডিত নাঙ্গপাদের কাছ থেকে তন্ত্র শিক্ষা এবং আচার্য শীল রক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দিক্ষা নেন।১০১১ খ্রীষ্টাব্দে, উনি মালয় সুবর্ন দ্বীপ যা ইন্দোনেশিয়া অবস্থিত। সেখানে তিনি ১২ বছর ধরে আচার্য ধর্মপালের কাছে বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা নেন। এবং সেখান থেকে এসে তিনি বিহারার বিক্রমশীলার অধ্যাপকের দ্বায়িত্ব নেন।অতীশ দিপংকর নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছিলেন যে পৃথিবীর কোন লোভ লালসা উনাকে জয় করতে পারে নি।উদাহরণ সরুপ বলতে পারি,তিব্বতের রাজা লহ লামা য়েসোশো,কয়েক জন দুত দিয়ে প্রচুর স্বর্ন উপঢৌকন দিয়ে পাঠান। কিন্ত অতীশ দিপংকর তা নেন নি। কারন সোনার চেয়ে উনার কাছে ধর্ম প্রিয় ছিল।সম্রাট পরবর্তীতে সোনা সংগ্রহের কাজে গেলে ভিন্ন রাজ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং মুক্তিপন দাবী করা হয়। সম্রাট উনার ছেলে লহা লামা চং ছুপ কে বলেছিলেন “আমার যা হয় হোক, তুমি অতীশ দিপংকর কে তিব্বতে আনার ব্যবস্থা কর এই মুক্তিপনের টাকায়”। পরবর্তীতে সম্রাটের ছেলে পুনঃরায় আবার বিক্রমশীলায় লোক পাঠান। এর প্রায় ১৮ মাস পর অতীশ দিপংকর তিব্বতে যান তিব্বতীদের ধর্মে ফেরানোর জন্য। সেটা ছিল ১০৪২ সাল। উনি প্রথমে যান থেলং নামের এক বিহারে। এবং সেখান থেকে তিনি রচনা করেন বিখ্যার গ্রন্থ বোধি পথ প্রদীপ।
অতীশ দিপংকর প্রায় ২০০ এর মত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন (অনেকের মতে ১৬৮)। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি,জীবনী অনেক কিছুই ছিল উনার লেখায়। এত কিছুর জন্য তিব্বতীয় রা উনাকে অতীশ উপাধীতে ভূষিত করেন। কয়েক টি গ্রন্থের নাম ছিল,চর্যা সংগ্রহ দ্বীপ,বোধীসত্ত্ব মন্যাবলী, লোকোত্তর সপ্তক বিধি,দশ কুশাল কর্মোপদেশ,কর্ম বিভঙ্গ ইত্যাদি।অতীশ দিপংকর ১০৫৪ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের কাছে চে থঙ্গের দ্রোলামা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।১৯৭৮ সালে প্রায় হাজার বছর পর ২৮ শে জুন এই মহান ব্যক্তির দেহভস্ম নিজ দেশে আনা হয়।
এই মহান মানুষ টাকে আমরা নাম দিয়েছি কি, নাস্তিক। উনার জন্মস্থানের নাম দিয়েছি কি,নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা।কেন দিয়েছি,কারন তিনি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম মতের মানুষ ছিলেন না।তাই উনাকে যে ভাবেই হোক ছোট করতে হবে,সামনে থেকে না হোক পিছন থেকেও হলেও উনার অবদান কে অস্বীকার করতে হবে।বাঙ্গালী হিসেবে নিজেকেই নিজের থু থু দিতে ইচ্ছে করছে।অতীশ দিপংকর শ্রীজ্ঞান, বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের ক্ষমা করবেন।আমরা আপনাকে চিনতে পারি নি,চিনতে পারব ও না।