ঢাকার দূরত্ব কক্সবাজার থেকেকত হবে ঠিক জানি না। যেহেতু বি সি এস পরীক্ষা দিবাে না, এগুলাে জানার কোন মানে হয় না। তবে এটুকু বলতে পারব, দূরত্ব অনেক। তবে হিসেব করলে নয় কি দশ ঘন্টার রাস্তা হতে পারে। এত লম্বা রাস্তা দিনের বেলায় অতিক্রম করতে হলে, বিরক্ত লেগে যায়। আমি যেহেতু কর্কট রাশির জাতক, সেহেতু আমার রক্তে চপলতা মিশে আছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই, জার্নিটা দিন ও রাত মিলিয়ে করার চিন্তা করলাম।
বাস ছাড়ার কথা বিকেল চারটায়, ছাড়লো সাড়ে চারটার পর। আমার সিট নম্বর এ-২। পাশে কারো একজনের বসার কথা। সে এখনাে আসছে না। যেহেতু অফিসার মানুষ, বক বক না করলে ভালো লাগে না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম পাশের মানুষটার জন্য।
যাইহােক যিনি পাশে এসে বসলেন উনার স্বাস্থ্য ছােট খাটো একটা হাতির বাচ্চার মত দেখতে। তার বিশাল শরীরের জন্য আমাকে অনেকটাই কাচুমাচু হয়ে বসতে হল। লোকটটি সিটে বসতেই তার মুখ থেকে জর্দার গন্ধ বের হতে থাকে। বুঝতেই পারছি ভদ্রলােক প্রচুর পান খান। বয়স কত আর হবে, আনুমানিক ৪৫ এর মত। ভদ্রলােক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, – তুমি কি আমাকে একটু জানালার কাছে যেতে দিবে।
লোকটির কথা শুনে আমি মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম। অফিসার হবার পর থেকে কেউ যদি তুই, তুমি শব্দ ব্যবহার করে তাহলে বিরক্ত লাগে। যদিও চেনা জানা মানুষ বললে এভাবে কেউ ডাকলে খারাপ লাগেনা কিন্ত অপরিচিত কেউ তুমি বললে মহা বিরক্ত লাগে। আমার কাছে মনে হয়, আমার চেহারায় একটা তুই, তুই টাইপ ভাব আছে।
প্রথমবার কক্সবাজার আসছি তাই ঝামেলা করলাম না। সুবােধ বালকের মত সিটটা ছেড়ে দিলাম। ভদ্রলােক, আবার বললেন, – তুমি চিন্তা করাে না, আমি সামনে নেমে যাব, আমার ভাগ্নি তােমার সিটে বসবে, তুমি, আবার নিজের সিটে আসতে পারবে। মনে মনে খুশি হলাম। যখন জানতে পারি, একটু পরেই পাশে একটা মেয়ে মানুষ এসে বসবে, কথায় কথায় কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে। এতে ভালোই লাগবে।
আবার ভাবলাম, মামার চেহারা স্বাস্থ্য দেখতে যে ড্রাম, ভাগ্নির জানি কি অবস্থা?
ভদ্রলােক আবার বললেন, তা তুমি কি করো বাবা।
আমি ভদ্রলােকের দিকে তাকিয়ে বললাম, – পড়াশুনা করছি। আর একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করি।
ভদ্রলােক কেনো জানি আমার কথা শুনে হাসলেন। এক গাল হেসে প্রশ্ন করলেন, – অফিসারদের তুমি করে বললে অফিসাররা রাগ করে, তাই না?
আমি চুপ করে থাকি, কিছু বলি না। ভদ্রলােক আবার বললেন, – তুমি অফিসার মানুষ, আমার ভাগ্নি তােমার সাথে গেলে কোন সমস্যা হবে না।
আমি কৌতুহল দমাতে পারি না। তাই জিজ্ঞেস করি, কি সমস্যা।
ভদ্রলােক বললেন আমার ভাগ্নিটা বিষন চাপা স্বভাবের। কারাে সাথে বেশি কথা বলে না। ছােট বেলায় বাবা-মা দুই জনই মারা গেছে। সেই কষ্ট মনে হয় সহ্য করতে পারে নি।
লোকটিকে তার ভাগ্নি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করছে শুনে আমি কিছু বলি না, এবারেও চুপ করে থাকি। এতিমদের কথা বললে, মনটা কেনো জানি খারাপ হয়ে যায় আমার। বাস ছাড়ার মােটামুটি দশ মিনিট চলার পর ভদ্রলােক বললেন, – সামনে আমি নামবাে।
আমি ভাদ্রলােককে উঠে নামার জন্য জায়গা করে দিলাম। বাস একটা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে থামল। আশ্চর্য ব্যাপার, ভদ্রলোক কোন কথা না বলে সোজা নেমে গেল। কিন্ত ভদ্রলােকের জায়গায় যে আসে তাকে কোনোভাবেই যেন মানুষ বলা চলে না। হাজার হাজার বছর ধরে কবি সাহিত্যিকরা যে রুপের বর্ননা করেও ব্যার্থ হয়েছেন। আসলে কিছু কিছু অবয়ও আছে যার বর্ননা করা সম্ভব হয় না, পারাও যায় না। পৃথিবী নাকি তিনজন সুন্দর চোখ নিয়ে জন্মিয়েছে। এক, সম্রাট অশোকের পুত্র কুনাল, দুই. হেলেন অফ ট্রয়, তিন. জোয়ান অফ আর্ক। আমার সামনে মনে হয় চতুর্থ জন দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটির চেহারায় একটা অদ্ভুদ মায়া আছে, সে মায়ায় যে কেউ পরতে বাধ্য। শ্যাম বর্নের মেয়েদের নাকি কাজল দিলে ভালো লাগে কিন্ত এই মেয়ের সৌন্দর্য্য যেন কাজল না, খোপার শিউলী মালা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কাজল দিলে যে শ্যাম বর্ন মেয়েদের না,উজ্জ্বল গৌড় বর্ন মেয়েদের ও যে ভাল লাগে, এই কথা মনে হয় কবি সাহিত্যকরা ভুলে গিয়েছিলেন।
মেয়েটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, – এটা আমার সিট।
আমি হাসিমুখে বলি, – হ্যা অর্পিতা , সিটটা তােমার।
আমার মুখে মেয়েটি তার নাম শুনে অবাক হয়ে গেল। কিছু বলল না, চুপচাপ নিজের সিটে বসল। বাস আবার চলতে শুরু করল। মেয়েটা নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে বলল, – আমার নাম নিশ্চয়ই ওই লােকটা বলেছে।
আমি হাসিমুখে বলি, – হ্যা।
যদিও বলেনি, তারপরও বললাম ,হ্যাঁ। মেয়েটি বলল, – আর কি বলল?
আমি বলি, – তােমার মামা হয় সম্পর্কে। তােমার মা বাবা দুই জন মারা গেছে, তুমি খুব চাপা স্বভাবের।
মেয়েটা বলল, – ওই লােকটা………..
আমি মেয়েটার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম, – তােমার মামা হয় না, তাই না? তােমার বাবা-মা দু’জনই বেচে আছেন। তুমি হাসি খুশি থাকতে পছন্দ কর। কিন্তু গত তিন চার বছর একেবারেই হাসতে ভুলে গেছ।
ফু দিয়ে একটা আলােকিত ঘরের মোমবাতি নিভিয়ে দিলে যেমন অন্ধকার হয়ে যায়, ঠিক তেমনি, মেয়েটার মুখটা অন্ধকারময় হয়ে গেল। কিছুক্ষন সময় নিয়ে মেয়েটা বলল, – আপনি জানেন কি ভাবে?
আমি আবার হাসি। আমার দাত গুলাে দেখিয়ে বলি, – দেখাে, আমার একটা এক্সট্রা দাঁত আছে। যাদের এক্সট্রা দাত থাকে, তাদের কথা এমনই মিলে যায়। আমারটাও মাঝে মাঝে এমনটা হয়, আর কি?
– আপনি আমাকে দেখে আর কি বলতে পারবেন?
আমি হাসি। হেসে বলি, – আর কিছু বলতে পারব না। তবে, আজকের পর থেকে তােমার জীবনটা আগের মত হয়ে যাবে।
আমি লক্ষ্য করলাম, মেয়েটার চোখ কেমন জানি চিক চিক করছে। – আপনার নামটা কি জানতে পারি? জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। আমি, আবার হাসলাম। হেসে আবার বললাম, – আমি কখনাে আমার নাম অপরিচিতদের বলি না। সাবধানে বসাে, দু-এক মিনিটে, বাসটা বিশাল ধাক্কা খাবে, টাইট করে বসাে ।
মেয়েটা আমার কথায় অবাক হয়। তারপর ও শক্ত করে বসল। কাকতালীয়ভাবে বাসটা বিশাল একটা ঝাকি খেল। রাস্তা ভাঙ্গা ছিল। তাই বাস ঠিক ওই ভাঙ্গার উপর দিয়েই চলে যাবার কারণে বাসে এই ঝাকুনি লাগা। বাসের ভেতর যে কয়জন ছিল, তারা সবাই ড্রাইভারকে ধমকাতে শুরু করে। ঘটনার পর মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি, এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, – এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
মেয়েটা বলল, – আপনি কি ভাবে জানেন, বাসটা ঝাকুনি খাবে?
আমি শান্তভাবে বলি, – শােন অর্পিতা, বাসের ড্রাইভার আর হেলপার দু’জন কথা বলছে। রাস্তা পুরাে ফাঁকা, আমি লক্ষ্য করলাম, ড্রাইভার হেলপারের দিকে একবার তাকাচ্ছে, একবার সামনের দিকে। সামনে যে, বিরাট গর্ত রয়েছে ড্রাইভার সেটা লক্ষ্যই করেনি। তাই অনুমান করে বলেছি, আর অমনি মিলে গেছে । এখন তুমি বুঝতে পারছ, ব্যাপার খানা। এতে অবাক হবার কিছু নেই। ছােট ছােট বিষয়গুলাে লক্ষ্য করলে বড় বিষয় সমন্ধে ধারণা পাওয়া যায় । তােমার নাম অর্পিতা এটা কিন্ত আমাকে তােমার বাগদত্তা লােকটা বলে নি। তােমার ব্যাগে লেখা আছে অর্পিতা সরকার আর তোমার হাতে লেখা রয়েছে “এ”। সেই থেকে বুঝলাম তােমার নাম অর্পিতা। এতে অবাক হবার এতো কি আছে?
মেয়েটা প্রশ্ন করল, – ওই লােকটা আমার বাগদত্তা আপনাকে কে বলল?
আমি হেসে বললাম – তােমার মামা হলে, তােমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে যেতাে, জানালা দিয়ে কথা বলতো, আর তুমিও ওনার সাথে নানা কথা বলতে। আমি লক্ষ্য করলাম তুমি ওনার দিকে একবারও তাকাও নি। এমন জানি এক ধরনের ঘৃনা বােধ করছ। তাই বুঝতে পারলাম লােকটা খুব পাওয়ারফুল, জোর করে তােমার সাথে কোন একটা সম্পর্ক করতে চাইছে আর তোমার মত এত সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে ছাড়া আর কি সম্পর্ক করতে পারে লােকটা।
অর্পিতা শোন,আমি অসাধারন কোনো লােক নই। শার্লক হোমসের বই পড়ি, তাই অনুমানের উপর ভিত্তি করে এইসব কথা বলেছি।অনেকটা বলতে পার পাজেল মিলিয়েছি। আর একটি কথা, বিশ মিনিট পর তুমি নেমে যাবে। চকরিয়াতে, ঠিক না? মেয়েটি এই প্রথম হাঁসলাে। হেসে বলল, – ঠিক ধরেছেন?
আমি বললাম, – কি ভাবে বললাম, শুনতে চাও?
মেয়েটি বলল,, – না। শুনতে চাই না। আমার আর অবাক হতে ভালাে লাগছে না।
আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলি, – তোমাকে একটা কথা বলি সোমা, শুনে তুমি চমকে উঠবে। আর এই বিশ মিনিটে তােমাকে আমি তিনবার চমকে দিব। মেয়েটা বলল, আমি আর চমকাতে চাই না। এমনিতেই অনেক চমকে গেছি। আমি বলি, তোমার বাগদত্তার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। উনি এখন হাসপাতালে আছে। বাঁচবে কি বাঁচবেনা সেটা বলতে পারছি।
– মেয়েটি চমকে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি?
আমি বলি, – তুমি তােমার বাবাকে ফোন কর।
মেয়েটি আমার কথা ফেলে দিতে পারছে না আর বিশ্বাসও করতে পারছে না। কেমন কাপা কাপা হাতে ফোন দিল। ও পাশ থেকে কি বলছে, বুঝতে পারছি না। শোনারও আগ্রহ নেই। ফোনটা নামিয়ে বলল, – ওই লােকটা কিছুক্ষন আগে বাসের সাথে অ্যক্সিডেন্ট করেছে কক্সবাজার মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবস্থা বেশী ভালো না। আপনি এটা জানার কথা না কোন ভাবেই । আপনি কিভাবে জানলেন?
আমি হাসি কিছু বলি না । মেয়েটা বলল, – আমি কি পরিমান খুশি হয়েছি আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। ওই লােকটা বিগত চারটা বছর আমাকে কি পরিমান যন্ত্রনা দিয়েছে, আমি আপনাকে বলে বােঝাতে পারব না। কতোবার যে আত্মহত্যার চিন্তা করেছি, বলে বােঝাতে পারবাে না।
আমি বলি, – তােমার অনেক ইচ্ছে করছে, আমার হাতটা ধরতে, আমার নামটা জানতে, ঠিকানা জানতে।
মেয়েটি দ্বিতীয়বারের মত অবাক হয়ে গেল সে। বলল, – হ্যাঁ ঠিক। আমি কি তােমার হাতটা ধরতে পরি।
মেয়েটি আমাকে প্রথমবারের মত তুমি করে বলল। শুনে ভালাে লাগল। আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি আমার হাত ধরতে পারাে না। কারণ আমি একজন নিশি মানব। নিশি মানবরা কখনাে কাউকে হাত ধরতে দেয় না। লক্ষ্য করলাম, মেয়েটার চোখ কেন জানি ঝাপসা হয়ে উঠল।
আমি, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, – তুমি আর কতক্ষন আছ, আমার সাথে?
মেয়েটা বলল, – তিন মিনিট।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, – অর্পিতা শোন, আমি তােমাকে ভালবাসি। I Love you.
মেয়েটি মনে হয় এমন অবাক কখনাে হয় নি। মেয়েটির চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল। এরপর মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে বলল, – আমি কেনো জানি তােমাকে ভালােবেসে ফেলেছি। এতো ভালো কাউকে কোনোদিন বাসিনি। আমি সামনেই নামবাে। তােমার মােবাইল নম্বরটা বল। Facebook ID-টা বলো, তাড়াতাড়ি। আবার কবে দেখা হবে?
আমি বলি, – অর্পিতা, নিশি মানবদের Facebook, মােবাইল থাকে না। আর, কোনো দিনও আমার সাথে তােমার দেখা হবে কিনা সেটা বুঝতে পারছিনা। তোমার ক্ষমতা প্রচন্ড প্রবল। প্রচন্ড ক্ষমতা ধর মানুষরা কখনো আমাকে খুঁজে পায় কখনো পায় না। তবে, এটা সত্যি কথা আমি তােমাকে ভালােবাসি, অনেক বেশি ভালবাসি।