এন্টনি ফিরিঙ্গী
লাইলি মজনু, শিরীন ফরহাদ, ইউসুফ জুলেখা, সবার নাম কিংবা তাদের প্রেম কাহিনী কথা মোটামুটি শুনেছি। তবে বেশির ভাগ ই গল্প। শাহ মোহাম্মদ সগীর ইউসুফ জুলেখার কাহিনী অতি রজ্ঞিত প্রেম উপাখ্যান ছাড়া আর কিছুই না। সত্যি কথা বলতে কি, এই যত গুলা প্রেম কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায় সব যেন বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য, আলাদিন খিলজি আর পদ্মাবতী, শাহাজাহান- মমতাজ, জাহাঙ্গীর -নুরজাহান।আসলে এদের কোন প্রেম কাহিনীই নাই। আপনি যদি মনে করেন হেরেমে কয়েক হাজার দাসী রেখে,কয়েক টা বিয়ে করে,একজন কে মনে প্রানে ভালবাসা যায় তাহলে সেটা ভুল এবং সাংঘাতিক রকম ভুল।
আজ এক ভিন দেশী যুবকের প্রেমের গল্প বলতে এসেছি। যে খ্রিস্টান হয়েও ভালোবেসেছিল বাংগালী এক মেয়েকে, তাও আবার বিধবা। এন্টনী ফিরিংগী আর সৌদামিনী।
এন্টনী ফিরিংগী, যার পুরা নাম হ্যান্সম্যান এন্টনী। উনার জন্ম ১৭৮৬ সালে আর মৃত্যু হয় ১৮৩৬ সালে। মুলত উনি একজন কবিয়াল ছিলেন। কবিগানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৯ শতকের শুরুর দিকে পর্তুগাল থেকে এসে বংগে ফরাশডাংগা নামক জায়গায় বসবাস করেন তিনি।মুলত বেশি ধনী না হওয়াতে, সমাজের উচ্চবানদের মত পার্টি তে যাওয়ার সুযোগ হত এন্টনী ফিরিংগীর।তাই তিনি মিশতেন গ্রামের সহজ সরল মানুষের সাথে। তাদের সাথে থাকতে থাকতে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর টান অনুভব করেন তিনি। বিশেষ করে কবিগানের প্রতি। সমাজে নিচু শ্রেনী লোকদের সাথে চলতে চলতে তাদের সংস্কৃতি কে ভালো বেসে ফেলেন তিন। সমাজের উচ্চ বিত্তরা যখন পার্টিতে যেত, তখন এন্টনীকে দেখা যেত গানের আসরে। বলাবাহুল্য গাজার প্রতি সম্ভব টান ছিল এন্টনীর। এক সময় গান করতে করতে গানের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দিনের বেলায় আডা দিতেন আর রাতের বেলা চলত গান।
এন্টনি ফিরিঙ্গী ছবিতে প্রসেনজিত ।
সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ গান শুনতে আসতে শুরু করল। একজন সাদা চামড়া লোক, খ্রিস্টান বাংলা গান করছে, মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনত। আর যাবার সময় কিছু অর্থকরি দিয়ে যেত। সেই আয়ে ই চলত এন্টনীর দিন। রাধা কৃষ্ণের গান, কৃষ্ণ নীলা, এন্টনীর গান সবাই মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনত।কিন্ত হাজার মানুষের ভিড়ে সবচেয়ে এইগান যাকে বেশী আকর্ষন করেছিল সে ছিল সৌদামিনী। ১৮,১৯ বছরের এক বিধবা মেয়ে। যাকে সতীদাহ করতে করতে, আর করা হয় নি। কোন রকমে প্রান বেচে গিয়েছিল তার। থাকত তার দাদার বাসায়।এন্টনী যখন গান করত তখন সবাইকে ফাকি দিয়ে চুপি সারে এন্টনীর গান শুনত সে।
বিধবা হওয়ায় বাড়ির সব কাজ করতে হত সৌদামিনী কে। আর সহ্য করতে হত অকথ্য নির্যাতন। এন্টনীর সাথে প্রায় ই দেখা হত সৌদামিনীর। এন্টনীর কেমন জানি এক ভাল লাগা কাজ করে উঠল তার প্রতি।ভালোবাসাটা জন্মাতে শুরু করল। কিন্ত ভালোবাসায় বাদ সাধল তত কালীন হিন্দু সমাজ।একজন খ্রিস্টান আর বিধবা হিন্দুর প্রেম তারা কি কোন দিন মেনে নিতে চাইবে।কোন একদিন, সৌদামিনী কে প্রচন্ড নির্যাতন করছিল তার দাদা বৌদি। অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতছিল সে। সেখান থেকে রক্ষা কর্তা হয়ে আসে এন্টনী। দাদার কাজ থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে আসল সৌদামিনী কে। জায়গা দিল তার নিজের ঘরে।আর ততকালীন সমাজ এই বিষয় টিকে ভালো ভাবে নেয় নি। একজন বিধবা, বাম্মন, কি ভাবে এক খ্রিষ্টান ছেলের সাথে বিয়ে না হয়ে থাকে।যাই হোক ঘটনা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, ছোট করি।
অবশেষে এন্টনী বিয়ে করে সৌদামিনী কে, তবে কোন প্রথা টথামেনে না।এমন কি সৌদামিনী কে এন্টনী খ্রিষ্টান ও বানায় নি। তবে এন্টনী সৌদামিনীর বিয়ের পর ফরাস ডাংগায় সমাজের চাপের জন্য থাকা হয়নি তাদের। গ্রাম ছারতে হয়েছিল সমাজের চাপে।
এন্টনি ফিরিঙ্গী ছবিতে নায়ক উত্তম কুমার ।
তবে এক বাম্ম্যন এর মেয়ে খ্রিস্টান কে বিয়ে করেছে এই ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিল না হিন্দু সমাজ প্রতি রা। তারা সুযোগ খুজতেছিল সৌদামিনী কে হত্যার। সেই সু্যোগ একদিন হয়ে যায়।।এন্টনী তখন বিরাট গায়ক। আর সৌদামিনীর গর্ভে তার সন্তান। একদিন এন্টনীর সুযোগ হয় জমিদার বাড়িতে গান করার। কিন্তু সৌদামিনী গর্ভবতী হওয়ায় যেতে চায় না সে। অবশেষে সৌদামিনীর পিরাপিরিতে জমিদার বাড়িতে যায় সে। আর এই সু্যোগ কাজে লাগায় হিন্দু ব্রাম্ম্যন রা।তারা ধর্মের নামে অধর্ম কে হত্যা করতে চায়। অনেক লোক মশাল জালিয়ে এগিয়ে যায় এন্টনীর বাড়ির দিকে। গর্ভবতী, সৌদামিনী তাদের কাছে তার সন্তানের প্রান ভিক্ষা চায়। কিন্ত তাকে টেনে হিচড়ে ঘরের ভিতর বন্ধী করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ঘরের ভিতরে। আগুনে পুড়ে মারা যায় সৌদামিনী ও তার অনাগত সন্তান। আর এ ভাবেই শেষ হয় এন্টনী আর সৌদামিনীর অমর প্রেম কাহানী ।