ভাওয়াল অঞ্চল কিংবা গাজীপুর জেলায় কালীগঞ্জ এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় যে একচেটিয়া খ্রীষ্টানদের বাস তা কিন্ত এমনি এমনি হয় নি। বাংলাদেশে যে কোন জায়গা থেকে এই অঞ্চলের খ্রীষ্টানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।এবং এই অঞ্চলের খ্রীষ্টানদের বংশধররা পরবর্তীতে স্থানান্তরিত হয়ে বংলাদেশের পাবনা রাজশাহী জেলাতে গিয়ে বসতি স্থাপন করছে।বাংলাদেশে একক উপজেলা বা থানা হিসেবে সবচেয়ে বেশী খ্রীষ্টান বসবাস করে গাজীপুরের কালীগজ্ঞে। কিন্ত এত খ্রীষ্টান কিভাবে এই অঞ্চলটাতে আসল,তা আসলে আমরা বেশীর ভাগ খ্রিস্টানই জানি না।কার মাধ্যমে কবে, কখন কিভাবে তা অনেকবার জানানোর চেস্টা করা হলেও আমাদের মাঝে এই তথ্য গুলো জানার আগ্রহ কম। তবে যারা এই ইতিহাস জানে কিংবা যারা এই ইতিহাসকে আমাদের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারত, আমাদের চার্চগুলো ও এই ইতিহাস গুলোকে সঠিক ভাবে জানাচ্ছেনা বলেই আমার মনে হয়। যেমন দোম অন্তনী ডি রোজারিও, এই নামটার সাথে কত জন পরিচিত। আমি হলফ করে বলতে পারি ২০% ভাওয়াল অঞ্চলের খ্রীষ্টান এই লোকটার কথা জানে না। অথচ এই লোকটা না থাকলে আমাদের খ্রীষ্ট ধর্মের বীজ কখনো গাজীপুরের কালীগজ্ঞে বপন হত না।দুঃখ জনক হলেও সত্যি এই লোকটার স্মৃতি চারন করে কোন একটা ভবন, অডিটোরিয়াম, কিংবা স্কুলের নাম ও রাখা হলো না। রাখলে হয়ত বা আমাদের খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের নিশ্চয়ই কোন ক্ষতি হতো না।কে এই দোম আন্তনীও, আর কেনই বা আমি উনার কথা বলছি,লেখাটা পড়লে আপনিও বুঝতে পারবেন। দোম আন্তনীও, যার জন্ম আনুমানিক ১৬৪৩ সালে। দোম আন্তনীও ছিলেন ভূষনার রাজপুত্র।১৬৪৯ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে আরাকান মগরা বাংলায় লুটতরাজ করার সময়, বহু নারী শিশুদের সাথে তাকেও বন্দী করে। কিন্ত যখন তার বংশ পরিচয় সমন্ধে জানতে পারে তখন মগেরা পর্তুগিজ নাবিকদের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়।দোম আন্তনীর পিতৃ পরিচয় পাওয়া যায় না।তবে অসর্মথিত সুত্র থেকে জানা যায় যে,বাংলার বারো ভুইয়াদের সীতারাম নামের একজন নবাব মুর্শীদকুলির কাছ থেকে কয়েকটি গ্রাম ইজারা নেন,এবং একটি রাজ্য গড়ে তুলেন। ধারনা করা হয়,এই সীতারামের ছেলে এই দোম অন্তনী ডি রোজারিও। আর পর্তুগীজরা দোম আন্তনীও কে আগষ্টিন ফাদার মানুয়েল ডি রোজারিও এর নিকট পুনঃরায় বিক্রি করে দেয়। ফাদার তাকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করতে চাইলে সে তার নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে চায় নি।কথিত আছে যে,স্বপ্নে যীশু খ্রীষ্টের সাক্ষাতের পর অবশেষে উনি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। এবং ফাদার তা নাম রাখেন দোম আন্তনীও ডি রোজারিও।যেহেতু ফাদার এর পদবী ছিল রোজারিও তাই উনি নিজের পদবী ছেলেটিকে দেন।”দোম “একটি পর্তুগিজ শব্দ, যার বাংলা হচ্ছে রাজপুত্র।দোম আন্তনী এই নামটি আমাদের কাছে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অজানাই ছিল। ১৯১৪ সালে একজন জেজুইট ফাদার, ফাদার হোস্টেন যিনি একজন ইতিহাসবিদ এবং গবেষক তিনিই আমাদের কাছে দোম আন্তনীওর পরিচয় করিয়ে দেয়। Bangal Past and Present, নিবন্ধে The Three first type printed Bengali Books, আলোচনা করতে গিয়ে এই নামটার সাথে আমাদের পরিচয় করে দেন।এর পর ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন আবার উনার প্রবন্ধে দোম আন্তনীও নামটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে এই নামটার সাথে সবচেয়ে বেশী পরিচয় করিয়ে দেন, ডক্টর তারাপদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত দোম আন্তনীও সমন্ধে পর্তুগীজ ফাদারদের অনেক চিঠি ও প্রতিবেদন উদ্ধার করেন। এবং তিনিই সর্বপ্রথম দোম আন্তনীও তথ্য নির্ভর জীবনী প্রকাশ করেন। তিনিই বলতে গেলে এই মানুষটাকে বংগে খ্রীষ্টান ইতিহাসের নায়ক হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। দোম আন্তনীও জন্মসাল ১৬৪৩ সালে, ১৬৪৯ সালে উনি অপহৃত হন।এবং ১৬৬৬ সালে তিনি, স্বজাতী এক মেয়েকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। শুধু তাই নয় উনি নিজের কাকীমা,এবং তার অনেক আত্নীয় স্বজনকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। দোম আন্তনীও ধর্মগুরু মাদার ম্যানুয়েল চট্রগ্রাম থেকে গোয়ায় বদলী হলে,দোম আন্তনীও চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন। দোম আন্তনীও মাত্র ২৩ বছর বয়সে খ্রীষ্টধর্মতত্ত্ব ও পর্তুগীজ ভাষায় পান্ডিত্য লাভ করেন। হিন্দু থেকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়া দোম আন্তনীও মাত্র দুই বছরে আমাদের এই ভাওয়াল অঞ্চলের প্রায় ২০ থেকে ত্রিশ হাজার মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন।এখানে একজন ফাদারের নাম উল্লেখ্য করা দরকার, যিনি ১৬৯৫ সালে নাগরী গ্রাম টি ক্রয় করেন। ফাদার লুই দস আজ্ঞস।ধারনা করা হয় মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে ফলে, এবং জমিদার কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকার হওয়া খ্রীষ্টানদের ভূষনার কোষাভাঙা থেকে নাগরীতে নিয়ে আসেন। নাগরীতে পরবর্তীতে উনি আরো পাচটি গ্রাম কিনেন? করান, তিরিয়া,বাগদী এই অঞ্চল গুলো।ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষের সাথে আমাদের ভাওয়াল অঞ্চলের খ্রীষ্টানদের ভাষাগত মিল থাকার একটা কারন হচ্ছে,এই অঞ্চলের অনেক খ্রীষ্টান ফরিদপুরের কোষাভাঙা থেকে আগমন করেছে।এখানে আরেকটি তথ্য উল্লেখ্য করা প্রয়োজন,যা অপ্রিয় হলেও সত্যি।নাগরী গীর্জার গায়ে যে সাল টা লেখা,মানে ১৬৬৩ এটি আসলে সঠিক নয়। কারন নাগরীতে প্রথম গীর্জা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৯৫ সালে বর্তমানে যে পুরানো কবর স্থানে, একটি মাটির ছনের ঘর তৈরীর মাধ্যমে।তাহলে নাগরীর গীর্জার গায়ে ১৬৬৩ আসলো কোথা থেকে? তার কারন কোষাভাঙ্গাতে চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৩ সালে, সেই সাল কে স্মরণ করেই নাগরীর গীর্জার স্থাপিত সাল ধরা হয়।নাগরীতে যে গীর্জাটি বর্তমানে ব্যবহার করা হয় না,মানে পুরাতন ওই গীর্জাটি স্থাপন করা হয় ১৮৮৮ সালে। যাই হোক,দোম আন্তনিও এত সুন্দর প্রাজ্ঞল ভাষায় যীশুখ্রীষ্টের প্রেম কাহিনী শুনাতে যে,এতে করে বহু সংখ্যক নিম্ন বর্ণের হিন্দু এবং অনেক মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। এই কথা যখন সুবেদার শায়েস্তা খান শুনেন, তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে দোম আন্তনীও কে কারাবন্দী করেন। তবে কোন এক অদ্ভুত কারনে শায়েস্তা খান দোম আন্তনীও কে কিছু দিনের মধ্যেই মুক্ত করে দেন। এবং উনাকে কিছু পতিত জমি ও দান করেন।তবে শর্ত দেন কোন মুসলমানকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা যাবে না,তবে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা যাবে।তারপরেও অনেক মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়েছেন,গোপনে।এই ভাওয়াল অঞ্চলের বেশীর ভাগ খ্রীষ্টানই, কামার, কুমার, তাতী, জেলে,মুচি,মেথর, চামার, থেকে কর্নভাট হওয়া। আঠারোগ্রামে যে সকল খ্রীষ্টান আছে,তারা মূলত পর্তুগীজ এবং তাদের চাকর বাকরদের, পর্তুগীজ ব্যবসায়ী এবং সৈন্যদের বংশ ধর।এই যে কীর্তন, বিয়ের সময় সিঁদুর, পালা গান সবই হিন্দুদের থেকে আমদানী করা,কারন আমরা কয়েক শ বছর পূর্বে হিন্দুই ছিলাম।এবার আসি,দুই যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিবাদে।এই অঞ্চল,প্রথম থেকেই আগষ্টিন ফাদাররা পরিচালনা করত। দোম আন্তনীওর এই অঞ্চলে আসার প্রধান কারন ছিল,এখানে আগষ্টিন ফাদাররা ছিল।একজন ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান একাই, পুরোহিত না হয়েও কিভাবে এত মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করল, এই বিষয়টি পুরো ইউরোপে চার্চার বিষয় হয়ে গেল।বিশেষ করে জেজুইটদের কাছে।যদিও এই বাংলায় রাজা প্রতাপাদিত্যর সময় জেজুইটরা যশোহরে মিশন স্থাপন করে ছিলেন, কিন্ত রাজনৈতিক কারনে তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।জেজুইটরা জানতে পারে, যে এই দোম আন্তনীওর মাধ্যমে ত্রিশ হাজার মানুষ খ্রীষ্টান হয়েছেন, কিন্ত এই মানুষগুলোর জন্য কোন যাজক নেই। আগষ্টিন ফাদারদের বার বার অনুরোধ করার পরও কোন ফাদার তারা দেয় নি,তখন জেজুইটরা দোম আন্তনীও কে সাহায্য করার জন্য আগ্রা কলেজের অধ্যক্ষ, ফাদার আন্তনী মগলই এস কে প্রেরন করেন। এবং উনি ১৬৭৮ সালে আগষ্টের ০২ তারিখে একটি প্রতিবেদন গোয়ায় জেজুইট সুপিরিয়র কাছে প্রদান করেন।এটি ছিল দোম আন্তনীও সম্পর্কে দ্বিতীয় পত্র।ফাদার,যখন এই অঞ্চলে আসলেন তখন তিনি জানতে পারলেন যে,দোম আন্তনীও যে মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে তার নাম ধর্ম নগর। তিনি যেখানে যাবার জন্য মনোস্থির করলে আগষ্টিন ফাদাররা তীব্রভাবে তার সেই জায়গায় যাবার বিরোধীতা করেন । তাই ফাদার বাধ্য হয়ে দোম আন্তনীও কে একটি লোক মারফত চিঠি লেখেন। এবং উনার সাথে দেখা করার অনুরোধ করেন।কিন্ত দোম আন্তনীওর কাছে সরকার খাজনা পাওয়ায়,সরকার তাকে নজর বন্দি করে রাখে।তাই তিনি আর ফাদারের সাথে দেখা করেন নি।ফাদার এই ঘটনা জানার পর লোক মারফত খাজনার টাকা দোম আন্তনীকে পাঠায়ে দেন। এবং এর কয়েকদিন পর খাজনা পরিশোধ হলে দোম আন্তনীও ফাদারের সাথে দেখা করেন। দোম আন্তনীও ছিল বেটে,শ্যাম বর্নের একজন মানুষ।উনি যে গ্রামে থাকতেন,সেটাই ছিল তার একমাত্র ইনকাম সোর্স।তা থেকে বছরে তিনি পঞ্চাশ টাকার মত পেতেন, কিন্ত সরকারকে বছরে একশ টাকা খাজনা দিত হত।এই কারনে তিনি সব সময় ঋনে জর্জরিত থাকতেন।ফাদার দোম আন্তনীওর মুখ থেকে সব শুনে উনার কনভার্ট করা খ্রীষ্টানদের দেখতে চাইলেন।কিন্ত আগষ্টিন ফাদাররা চরম বিরক্ত হন। এবং ওই অঞ্চলের দেখাশোনার দ্বায়িত্বে থাকা আগষ্টিন সম্প্রদায়ের ফাদার,ফাদার জ্যাও দ্য আসেনসাও দোম আন্তনীও কে ডেকে চরম অপমান করেন। কারন দোম আন্তনীও আগষ্টিন ফাদারদের দয়াই চলছিলেন।উনাকে যিনি খ্রীষ্টান বানিয়েছিলেন তিনিও আগষ্টিন সম্প্রদায়ের ফাদার ছিলেন।এবং ফাদার জ্যাও দোম আন্তনীও কে জেজুইটদের সংগ ছাড়তে বললেন,অন্যথায় তা যে বিশ্বাসঘাতকতা হবে সেটাও বলে দিলেন।দোম আন্তনীও সেই ধমকে ঘাবড়ে গেলেন। উনি ফাদার মগলইএস কে সব জানালে ফাদার তাকে সাত্ত্বনা দেন, এবং ধর্মান্তরিত হওয়া খ্রীষ্টানদের যত্ন নিতে বলেন। তবে ফাদার মগলই এস কোন এক অন্ধকার রাতে, কুড়ি টাকায় নৌকা ভাড়া করে,খুব গোপনে দোম আন্তনীও প্রতিষ্ঠিত ধর্ম নগর দেখতে আসলেন।ফাদার প্রথম আসেন হাকিম পুর নামে এক গ্রামে যেখানে ৫০০ ঘর খ্রীষ্টানের বাস ছিল। এরপর ফাদার শাম,শানন, ধাররয়ব,সাগরলী,মাসদিয়া, করিশে,সাবাপুর,আগরজান্দিয়া, দগদগা,সোনাতিয়া, ঘোড়াঘাট,বরইতলা এবং রাঙ্গামাটিয়া ভ্রমন করেন। বর্তমানে এই নাম গুলো নাই। এই সব অঞ্চলে মোটামুটি ২০ থেকে ত্রিশ হাজার খ্রীষ্টান বাস করত।তবে দোম আন্তনীও ১৪ বছর ধরে আগষ্টিন ফাদারদের অনুরোধ করেছিলেন যে,এখানে এক জন ফাদার স্থায়ী ভাবে থাকা দরকার।কিন্ত আগষ্টিনরা তার অনুরোধে কর্নপাত করে নি।এই কথা বিবেচনায় রেখে, জেজুইট রা বাংগলাকে তাদের মিশনের অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৬৮০ সালে ২২ শে এপ্রিল জেজুইট প্রভিন্সিয়াল এক আদেশ জারি করেন যে,ফাদার আন্তনী সন্তচ্চি নামে একজন কে বাংগার জেজুইটদের প্রধান নিযুক্ত করেন এবং সাথে আরো তিনজন ফাদার নিযুক্ত করেন।সাথে এও বলে দেওয়া হয়, যদি আগষ্টিনরা কোন বাধার সৃষ্টি করে,তাদেরকে বলতে হবে যে,জেজুইটরাই প্রথম বাংলায় আসেন, আর দোম আন্তনীও ১৪ বছর ধরে পালক চেয়েও পাচ্ছে না।তাই এই স্বীধান্ত।ফাদার আন্তনীর, নেপাল যাবার কথা ছিল বাণী প্রচারের জন্য।কিন্ত সেখানে ছয় মাস থাকার পর তিন বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি যখন এই অঞ্চলে আসেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে,দোম আন্তনীও কে দেনার দায়ে জেলে ভরে রাখা হয়েছে।তিনি দীর্ঘ এক মাস অপেক্ষা করেছেন দোম আন্তনীওর সাথে দেখা করার জন্য।কিন্ত তিনি বিফল হন। তবে তিনি এই অঞ্চলের দোম আন্তনীও দ্বারা দীক্ষিত অনেক খ্রীষ্টানকে পেয়ে যান। তবে ফাদার সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হন,তিনি যে অঞ্চলকে সমতল ভূমি মনে করেছিলেন সেটি আসলে এক বিশাল জলাভূমি।এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে কোন কোন সময় তিন দিন পর্যন্ত লেগে যায়। চারিদিকে মশা আর বিষাক্ত কিট পতঙ্গের কারনে তিনি ঠিক মত ঘুমাতেও পারেন নি।অথচ এই জায়গাকে নিজের করে রাখতে দোম আন্তনীও দেনার দায়ে জেলে পরে মরছিলেন।ফাদার এক বার এই দোম আন্তনীও কে জেলে দেখতে গেলে, তিনি দোম আন্তনীও কে প্রস্তাব দেন যে,তিনি এই অঞ্চল টি যেন যে কোন মূল্যেই বিক্রি করে যেন। কিন্ত দোম আমাদের এই অঞ্চল বিক্রি করতে অস্বীকার করেন। তিনি ফাদার কে স্পষ্টই জানিয়ে দেন,তিনি এই অঞ্চল কিছুতেই বিক্রি করবেন না।ফাদার তার কথা শুনার পর,আগষ্টিন সম্প্রদায়ের ভিকার জেনারেল ফাদার জুলিয়া ডি গ্রাসাও কে জেজুইটরা যে, দোম আন্তনীওর দীক্ষিত খ্রীষ্টানদের পরিচর্যা করতে চান, সেটা জানান।ফাদার জুলিয়া ডি গ্রাসাও, জেজুইটদের জানান যে,দোম আন্তনীওর গড়ে তোলা খ্রিস্টান পল্লীতে সেবা দেবার জন্য যথেষ্ট যাজক তাদের নেই।জেজুইটরা যেন সেই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্ত ফাদার জুলিয়া ডি গ্রাসাও কিছুদিনের ভিতর মন পরিবর্তন করেন এবং তিনি স্পষ্ট ভাবে জেজুইটদের জানিয়ে দেন এই অঞ্চলে জেজুইটদের কোন কাজ করতে দেওয়া হবে না।এবং তারা একটি চুক্তির নকল জেজুইট ফাদারদের সামনে তুলে ধরেন। এই চুক্তির নাম ছিল লারিকল চুক্তি।যা সম্পাদিত হয়েছিল দোম।আন্তনীও এবং আগষ্টিন ফাদারদের মধ্যে।এই বিষয় ছিল এই যে,”বাংলায় অঞ্চলের এত লোককে আমি এইভাবে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে ভুল করেছি,যার জন্য আমি অনুতপ্ত। এই ভুল আমি আর করব না।অন্য সম্প্রদায়ের যাজকদের এই অঞ্চলে আগমন যথাশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করব।বিশেষ করে জেজুইটদের।তার এর বিপরীত ঘটলে আগষ্টিন ফাদারগন যে শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিব। নিচে দোম আন্তনীওর সাক্ষর।এই চুক্তি পত্র দেখে জেজুইট ফাদার খুবই কস্ট পেলেন। তবে তিনি জানতে পারেন যে, এই অঞ্চলে এক জন পর্তুগীজ ব্যবসায়ী ছিলেন, যার নাম ছিল নিকলাস ডি পায়বা।তিনি ৫০০ টাকার বিনিময়ে দোম আন্তনীও কে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এবং নজর বন্দী করে রাখেন। এক রাতে চার জন মানুষকে পাঠিয়ে ছিলেন দোম আন্তনীও কে হত্যা করার জন্য। যদিও সে যাত্রায় পালিয়ে বেচে যান ভাওয়াল খ্রীষ্টধর্মের ভিত্তি প্রস্তরকারী দোম আন্তনীও ডি রোজারিও। দোম আন্তনীও খ্রীষ্টানরা আনুমানিক ৫০ টি গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।ভাওয়াল অঞ্চলের এই পঞ্চাশটি গ্রাম ছিল।ভাওয়ালের এই ধর্ম পল্লীগুলো দেখলেই বুঝা যায় কোন গ্রাম গুলো ছিল।এই গ্রাম গুলোতে যাতায়াত করতে নৌকা ছাড়া আর কোন বাহন ছিল না।জেজুইট ফাদার মার্কো সন্তুচ্চি,এবং তার সাথে আসা আরো তিন জন ফাদার ঠিক মত দোম আন্তনীওর গড়া খ্রীষ্টানদের পরিচর্চা করতে পারছিলেন না।যার ফলে এক সময় জেজুইটরা এই অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে মুছে যায়। জেজুইটদের এই অঞ্চল ছাড়ার কারন, ফাদার মার্কোর একটি চিঠিতে বুঝা যায়।যা তিনি লেখেন ১৬৮১ সালের ৬ ই নভেম্বর।গোয়ায় জেজুইট প্রভিন্সিয়ালকে।তিনি জানান যে,দোম আন্তনীওর খ্রীষ্টানরা, তাদেরকে হুমকি দিচ্ছেন যে,জেজুইটরা যদি তাদের দ্বায়িত্ব না নেয় তাহলে তাদের মেরে এই অঞ্চল থেকে বের করে দেওয়া হবে।আর আগষ্টিন ফাদাররা তাদের কে প্রকাশ্যেই বলছিলেন এই অঞ্চলে তাদের ধর্ম প্রচারে অধিকার নেই।তিনি বুঝতে পারেন যে,যেহেতু আগষ্টিন ফাদারদের কারনে দোম আন্তনীও মুক্তি পেয়েছিলেন তাই তিনি তাদের পক্ষেই চলে গেছিলেন। এবং মদ্যপানের দিকে আসক্ত হয়ে পরছিলেন।উনি উনার চিঠিতে এই অঞ্চলের মানুষের দুই চেহারা তুলে ধরেন।তিনি লিখেন যে,এই অঞ্চলের মানুষ না হিন্দু না খ্রীষ্টান। এরা কেউ মারা গেলে বাম্মন দিয়ে চিতায় নিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে আবার বিয়ে করার সময় চার্চে করে।তিনি বুঝতে পারেন যে,এদের দিয়ে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা ঠিক মত পালন হবে না।তাই তিনি তাদের ছেড়ে যেতে মনস্থির করলেন।। এবার প্রশ্ন আসতে পারে,দোম আন্তনীও যে অঞ্চল টিতে ছিল ওই অঞ্চলে কেন আগষ্টিন ফাদাররা যাজক দেন নি।তার উত্তর পাওয়া যায় ১৬৭৯ সালে আগষ্টিন ফাদারদের এক চিঠিতে।আগষ্টিন ফাদাররা মূলত ১৩ টি ধর্মপল্লী চালাতো।যার মধ্যে ঢাকা এবং তেজগাও ও ছিল। কিন্ত দোম আন্তনীও যেহেতু তাদের পালিত মানুষ ছিল তাই কোন ফাদার এই পালিত মানুষের হাতে গড়া খ্রীষ্টানদের সেবা দিতে চান নি।কিন্ত ১৬৮২ সালে একটি চিঠি আগষ্টিন ফাদারদের মূল কর্তৃপক্ষের নিকট, একটা চিঠি পাঠান।কে বা কারা পাঠান সেটা জানা যায় না।তবে দোম আন্তনীওর এই ত্রিশ হাজার খ্রীষ্টান কে কেন ঠিক মত পরিচর্যা করা হচ্ছে না,তা জানতে চেয়ে আগষ্টিন ফাদারদের অধিকর্তা পর্তুগালের রাজপুত্র ডন পেত্রত্রো, বাংলায় অবস্থিত আগষ্টিন ফাদারদেরকে কারন দশানোর নোটিশ প্রেরন করেন। এই চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে আগষ্টিন ফাদার গন, এই মর্মে চিঠি দেন দোম আন্তনীও আসলে এক জন ভন্ড। উনার দীক্ষিত খ্রীষ্টানদের সংখ্যা মোটেও ত্রিশ হাজার নয়। মাত্র ৫০ থেকে বিশ জন।এই সংখ্যা আসলে জেজুইটরা বিশ্বাস করেন। দোম আন্তনীও তার স্ত্রী, তার দুই ভাই ও একজন রাজাটাকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে।যা সর্বসাকুল্যে মাত্র বিশ জন।আর বাকী যারা আছে তাদের আগষ্টিন ফাদারগন ই দীক্ষিত করে।আর যেহেতু দোম আন্তনীওর খ্রীষ্টানগন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,তাদের শিক্ষা দেবার জন্য পর্যাপ্ত যাজক তাদের নেই।সেই পত্রে এই লেখা হয় যে,আসলে নিম্ন বর্নের হিন্দু,ভিক্ষুকরা ভিক্ষা পেতেই খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে শুধুমাত্র ভিক্ষার জন্য।আসলে তারা আদোতে খ্রীষ্টান নন।কিন্ত আগষ্টিন ফাদাররা যাদের দীক্ষিত করেছেন,তারাই প্রকৃত খ্রীষ্টান। তাদের চালচলন প্রকৃত পর্তুগিজ খ্রীষ্টানদের মত। কিন্তু আসলেই কি দোম আন্তনীও এইজন ভন্ড,জোচ্চর কিংবা অসাধু ব্যক্তি ছিলেন।ব্যাপারটা আসলে এমন না।এই অংশ টুকু লিখতে গিয়ে আমাকে অনেক গুলো অপ্রিয় হলেও সত্য কথা লিখতে হচ্ছে।আশাকরি পাঠক ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর ওই সময়কার আগষ্টিন ফাদারদের দোষ আমারা কখনো এই সময়ের ফাদারদের কিংবা সম্প্রদায়কে দিতে পারি না।আর আমরা আগষ্টিন সম্প্রদায়ের ফাদারকেও তাদের অবদানের জন্য ভুলতে পারি না।সত্যি কথা বলতে কি,জেজুইটরা এই বাংগলায় প্রথম।আসে।তারা এসেই ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে যে কাজ টা করেছে, তাহল শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।বিভিন্ন স্কুল কলেজ, হাসপাতাল তৈরী করেছিল। এই জন্য তাদের নাম ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চারিত হতো।রাজা, বাদশারাও তাদের সম্মান করত।যখন বাংলায় জেজুইটরা কিছুটা দুর্বল অবস্থানে চলে যায় তখনই আগষ্টিন সম্প্রদায়ের ফাদাররা তাদের স্থান দখল করে।তবে এই ও সত্যি কথা জেজুইটদের মত অর্থ এবং লোকবল কোনটাই আগষ্টিন ফাদারদের ছিল না।দোম আন্তনীও আসলে ধর্মের জলোচ্ছ্বাস তৈরী করে ছিলেন।যা সামাল দেবার ক্ষমতা ততকালীন আগষ্টিন ফাদারদের ছিল না।মাত্র দুই বছরে ত্রিশ হাজার মানুষকে খ্রীষ্টান বানানো এই জন বাংগালীর পক্ষেই সম্ভব ছিল।সেটা ছিল দোম আন্তনীও ডি রোজারিও। একজন বাংগালীই জানে কিভাবে বাংগালীকে বুঝাতে হয়। যা কোন সাদা চামড়ার ইউরোপীয়দের জন্য সহজ ছিল না।এই কাজটাই দোম আন্তনীও আমাদের এই ভাওয়ালে করে গেছেন।তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, না জেজুইট না আগষ্টিন কোন সম্প্রদায়ের কাছেই দোম আন্তনীও ভালো লোক ছিলেন না।এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ই এই লোকটাকে বার বার ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।কোন সম্প্রদায় দোম আন্তনীও কে ভালো না বাসলেও দোম আন্তনীও কে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিল এই ভাওয়ালবাসী।এবং তাকে জন্মদেওয়া এক ফাদার,ফাদার ম্যানুয়েল ডি রোজারিও এক জন রাজপুত্র হয়েও দেনার দায়ে জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। তিনি ইচ্ছা করলেই পারতেন নিজ পিতৃভুমিতে ফেরত যেত কিংবা নিজ ধর্মে ফিরে যেতে। কিন্ত তিনি যান নি? নিজের মনের মাঝেই এই প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খায়, দোম আন্তনীও কি পারতেন না নিজ ধর্মে ফেরত যেতে? তিনি কি পারতেন না নিজের রাজত্যে ফিরে গিয়ে রাজা হয়ে বাচতে? নিম্ন বর্নের মানুষ গুলোকে কি বাঙ্গালী উপায়ে খ্রীষ্টকে চিনানো কি দোম আন্তনীওর পাপ ছিল? কেন তিনি বার বার প্রস্তাব পাবার পর ও এই অঞ্চল বিক্রি না করে চলে যান নি? আজকে এই অঞ্চলে খ্রীষ্টানদের এত বেশী আধিক্য, কিন্ত দোম আন্তনীও এর নামে কি একটা চায়ের দোকান কি আমরা দিতে পেরেছি? দোম আন্তনীও ১৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যবরন করে।অথচ উনার কবর কোথায় সেটাই আমাদের অজানা?#বাংলাদেশের_খ্রীস্টমন্ডলীর_ইতিহাস