স্কুল জীবনে কবিতা পড়ার সময় যখন স্যার অনেক টা বিতৃষ্ণা হয়েই বলতেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত লোভে পরে,কবি হবার চরম বাসনা নিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। আর আমরাও সেটা মনে মনে বিশ্বাস করে নিতাম কিংবা এখনো বিশ্বাস করি।মৌলবাদীদের ভয়ে নতজানু যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় খ্রীষ্ট ধর্মের মাহাত্ন দেখতে পাবেন সেটা কিভাবে ভাবলেন আপনি। ড.হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতা ছিল “বই” এই কবিতা নাকি ধর্মের অবমাননা করে লেখা তাই এই কবিতা পাঠ্য বই থেকে বাদ দেওয়া হল।হিন্দু কবি লেখকদের, সব ধরনের লেখা বাদ দেওয়া হলো। অথচ বাংলা সাহিত্যকে জন্ম ই দিয়ে গেছেন হিন্দু – বৌদ্ধ লেখক রা। চর্যাপদের সাড়ে ছেচল্লিশ টা কবিতার সব গুলা ই তাদের লেখা। মধ্যযুগ শুরুই হয়েছে হিন্দু লেখকদের হাত ধরে।মনসা মঙ্গল কাব্য,বৈষ্ণব পদাবলি,শ্রী কৃষ্ণ কৃর্তন, সব গুলো ই তো হিন্দুদের হাতে লেখা।আধুনিক যুগের ইশ্বর চন্দ্র, বিদ্যাসাগর না থাকলে বাংলা অক্ষর ই থাকত না।তাদের আজ উপেক্ষিত করা হয়েছে।মাইকেল মধুসূদন দত্ত না থাকলে বাংলা সাহিত্য পেত না মহা কাব্য, সনেট। হুমায়ন আজাদ বলেছিলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাই বাংলা সাহিত্য কে ৫০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ আরো ১০০ বছর আর সেখানে আজ আমাদের পাঠ্য বইয়ে উনাদের কে উপেক্ষা করা হয়েছে। আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করেছে,তাও আবার যীশুকে ভালোবেসে, এক কথা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে স্থান পাবে এই কথা সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করি না।
আমি মাইকেল মধুসূদনের সাহিত্য কর্ম নিয়ে কথা বলব না।কথা বলব উনার খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন নিয়ে।২৫ শে জানুয়ারী ১৮২৪ সালে রাজ নারায়ন বসু এবং জাহ্নবী দেবীর কোলে জন্ম গ্রহন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।প্রচন্ড অভিজাত আর বিলাশ বহুল জীবন যাপন ছিল উনার। মুসলিম মৌলভীর কাছেও পড়াশুনা করেছেন উনি।হিন্দু কলেজে পড়াশুনার সময় থেকেই খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি টান জন্মে মধুসূদন দত্তের। পাশাপাশি ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি ও ব্যাপক আগ্রহ জন্মে উনার। এই আগ্রহের পিছনে ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রফেসর রিচার্ডসন এবং তার ছেলে। উনাদের ব্যাপক উৎসাহের কারনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজী কবিতার প্রতি ব্যাপক অনুপ্রাণিত হন। মুলত জর্জ গর্ডেন বায়রন বা লর্ড বায়রন উনার লেখার অন্ধ ভক্ত ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।এবং বাস্তব জীবনে উনাকেই অনুসরণ করতেন তিনি। এই কারনে মাইকেল মনে করতেন যে,একজন সত্যি কারের ইংরেজী সাহিত্যের কবি হতে গেলে উনাকে অবশ্যই ইংল্যান্ড যেতে হবে। কারন উনার সমস্ত অনুপ্রেরনাদায়ী রাই যে সেখানে।ওয়ার্ডওয়াথ, স্পেন্সার,কিটস, মুর সবাই এ উনার অনুপ্রেরনা।
১৮৪০ সালে ছেলেকে এই সাহিত্য কর্মের ভুত থেকে দূরে রাখতে বিয়ের ব্যবস্থা করেন, মাইকেলের বাবা মা।কবি হওয়ার স্বপ্ন, এবং ইংল্যান্ড যাবার মন বাসনা ছিল মাইকেলের। তাই উনি ১৮৪৩ সালের ৯ ই ফেব্রুয়ারী হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টধর্ম গ্রহন করেন। আর নামের আগে যুক্ত হয় মাইকেল। খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহন করার দুই টা কারন ছিল,বলে মনে করা হয়। এক খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহন করলে উনার বাবা মা আর বিয়ের জন্য পীড়া দিবে না আর দ্বিতীয়ত,খ্রিষ্টানদের সহচার্যে এসে ইংরেজী সাহিত্যে মনোনিবেশ করা যাবে। তবে বলে রাখা ভাল, ছোট বেলা থেকেই হিন্দু আর ইসলাম ধর্মের সহচর্য লাভ করেছিলেন তিনি। কিন্ত এই দুই ধর্মের প্রতি ই উনার তেমন আগ্রহ ছিল না।তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায় যে, উনি খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি একটা সফট কর্নার ছিল উনার। উনি উনার দীক্ষাস্নান নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবিতাও লিখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত দীক্ষাস্নান নিয়ে বলেছিলেন,” আমি এত দিন অন্ধকারে ছিলাম এবং আমি এখন মুক্তির আলো খুজে পেয়েছি।”
দীক্ষাস্নান নিয়ে মাইকেলের কবিতা ই প্রমান করে যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধীরে ধীরে খ্রীষ্ট বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৪৯ সালে আদম হবার কাহিনী নিয়ে লেখেন “ভিশন অফ দ্যা পাস্ট “। এমন কি খ্রীস্ট ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে ১৮৫০ সালে উনি সনেটও রচনা করেছিলেন।মধুসূদন ১৮৪৮ সালে ৩১ শে জুলাই রেবেকা ম্যাক টাভিশ নামের ১৭ বছরের এক নারীকে বিয়ে করেন। এই নারীর কারনে মাইকেল বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। হিব্রু,ফার্সী,ইটালিয়ান,তামিল, তেলেগু ভাষায়। উনার গর্ভে জন্ম নেয় ৪ জন।কেনেথ বার্থা,রেবেকা সালফেন্ট,জর্জ জন ম্যাক টাভিস,মাইকেল জেমস টাউন।১৮৫৫ সালে মাইকেল আর রেবেকার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে হিন্দু কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল,খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করার কারনে। কারন কোন হিন্দু যদি খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করে তবে তা অন্য ছাত্রদের উপর প্রভাব পড়তে পারে এই ভয়ে।সেই দিন গুলোতে মাইকেল কে আশ্রয় দিয়েছিল টমাস স্মিথ নামের একজন। ১৮৪৪ সালে উনি যখন স্মিথের এখানে থাকতেন তখন ই খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি এক গভীর মায়ায় পরে যান। মি.স্মিথের কারনে উনি খ্রীষ্ট কে ভালোবাসতে শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে ৯ নভেম্বর মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভর্তি হন বিশপ কলেজে। কারন ইংল্যান্ড থেকে খ্রীষ্ট ধর্ম পড়ানো এবং বানী প্রচারক তৈরী করতে ইংল্যান্ড থেকে পাদরীরা আসতেন এখানে।মাইকেলের খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আগ্রহ জন্মায় যে, তিনি অনেক বার মিশনারী হতেও চেয়েছিলেন। ১৮৪৫, ১৮৪৬ সালে দুবার চেস্টা করেন মিশনারী হবার জন্য। উনি প্রকাশ্যেই ঘোষনা দিয়েছিলেন উনি মিশনারী হবেন। যাই হোক পরবর্তীতে সেটা আর হয়ে উঠা হয় নি উনার।
১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড ডাব্লিউ মর্টিন একটা বই লিখেছিলেন,” মধুসূদন কনভার্সন “।এই বইটা এখন আর পাওয়া যায় না,খুবই বিরল। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে প্রভাবিত করেন তিনি ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দোপধ্যায়। আর আরেক জন ছিলেন যিনি ছিলেন এই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বাংগালী ব্যারিষ্টার জানেন্দ্র মোহন ঠাকুর,তিনিও খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। আরেক জন মানুষ কে বলা হয়, মাইকেলের জীবনের প্রভাবক।তিনি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী ১৩ বছর বয়সী আমেলিয়া হেনরিয়েটা। উনার গর্ভে কবির চারজন সন্তান ছিল। এলাইজা শমিষ্টা দত্ত,মেঘনাথ মিল্টন দত্ত,আলবার্ট নেপোলিয়ন দত্ত,আর একজন জন্মের পরেই মারা যান।
যাই হোক,১৮৭৩ সালে ২৯;জুন কবি মারা যায়। ১৮৭৩ সালের ৩০ জুন ড.পিটার জন জার্বো নামের এক খ্রীষ্টান পার্দী কলকাতার সেন্ট জেমস চার্চে খ্রীস্টিয় রিতিতে কবিকে সমাহিত করেন।আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর পশ্চিমাদের টিমথি পেনপোয়েম এই ভাবে বেচে আছেন আমাদের মাঝে।